রক্তের সিঁড়ি বেয়ে চলা মুসলিম ব্রাদারহুড
মিসরসহ সারা মধ্যপ্রাচ্যেই ইসলামপন্থী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখা রয়েছে। তবে মিসরেই তারা সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। আর দেশটিতে তাদের রয়েছে রক্তের সিঁড়ি বেয়ে পথচলার বিশাল এক ইতিহাস। ১৯২৮ সালে একটি ইসলামপন্থী সমাজসেবী সংগঠন হিসেবে তরুণ হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। এরপর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে সময়ের পরিক্রমায় তারা শিকার হয় বিভিন্ন সরকারের দমন-পীড়নের। প্রায় এক শতাব্দীকালের ইতিহাসের অর্ধেকটা সময়ের বেশিই তারা নিষিদ্ধ ছিল মিসরে। কিন্তু ২০১১ সালে আরব বসন্তে মিসরীয় গণজাগরণের পর তারা উঠে আসে ক্ষমতার শীর্ষ অবস্থানে।
ব্রাদারহুডের পথচলা শুরু ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে। সুয়েজ খাল তীরবর্তী শহর ইসমাইলিয়ায় হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ নামে এর যাত্রা শুরু হয়। ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণকারী বান্নার বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইখওয়ানুলের যাত্রা শুরু হয় ইসলামী ভাবধারার সংগঠন হিসেবে। দেশটিতে তখন ক্ষমতায় ছিল ব্রিটিশ প্রভাবিত সরকার। যাত্রা শুরুর পর ইখওয়ানুল মুসলিমিন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে সংগঠনটি মিসরে গড়ে তোলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। সেই সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবেও আবির্ভূত হয়। বহির্বিশ্বে অবশ্য সংগঠনটি পরবর্তী সময়ে পরিচিতি লাভ করে মুসলিম ব্রাদারহুড নামে।
১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে মিসরের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমি আন-নুকরাশি মুসলিম ব্রাদারহুডকে বিলুপ্ত করার নির্দেশ জারি করেন। ওই নির্দেশের কিছুদিনের মধ্যেই এক ব্রাদারহুড সমর্থকের হাতে প্রাণ হারান নুকরাশি। এরপর সরকারি বাহিনী সংগঠনটির বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমন অভিযান চালায়। এর পরের বছরের ডিসেম্বরে দলটির প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্না সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন। ১৯৫৪ সালে আরব জাতীয়তাবাদী নেতা গামাল আবদুন নাসেরের বিপ্লবের প্রতি মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থন জানায়। কিন্তু মতপার্থক্য ও অবিশ্বাসের কারণে দুইপক্ষের মধ্যে খুব দ্রুতই ভাঙন সৃষ্টি হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট নাসের ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান চালান। গামাল আবদুন নাসের এক হত্যাপ্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়ার পর দলটিকে আবারো নিষিদ্ধ করা হয় মিসরে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত গামাল আবদুন নাসেরের শাসনামলে হাজার হাজার ব্রাদারহুড নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং হত্যা করা হয়। ১৯৬৬ সালে তাদের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিত সাইয়েদ কুতুবকেও ফাঁসিতে ঝোলায় সরকার।
আনোয়ার সাদাত ১৯৭১ সালে মিসরের ক্ষমতায় এলে তার সরকারের সঙ্গেও তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে ব্রাদারহুডের। আনোয়ার সাদাত মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে দলটির ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা বহালই থাকে। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ১৯৭৯ সালে আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করলে স্বভাবতই তার ওপর ক্ষুব্ধ হয় ব্রাদারহুড। তাই ১৯৮১ সালে এক সামরিক কুচকাওয়াজ চলার সময় টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই তরুণ সেনা কর্মকর্তা খালিদ ইস্তাম্বুলি প্রেসিডেন্ট সাদাতকে গুলি করে হত্যা করেন। ধারণা করা হয়, খালিদ ইস্তাম্বুলি মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
তবে ব্রাদারহুড সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮৪ সালে এসে। প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক তখন এটিকে একটি ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানান। এ কারণে দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। ২০০৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থীরা মিসরের পার্লামেন্টের এক-পঞ্চমাংশ আসন লাভ করেন। ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের ভোটে ব্রাদারহুডের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নেননি।
এরপর আরব বসন্তের নবজাগরণের হাওয়ায় ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একনায়ক হোসনি মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। মুসলিম ব্রাদারহুড আবার রাজনীতিতে প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শাখার নাম দেয় ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’। ২০১২ সালের ৩০ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫১.৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন ব্রাদারহুডের নেতা মোহামেদ মুরসি। এরপর প্রথমবারের মতো দেশটিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো নেতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। মুরসি ছিলেন দেশটির ইতিহাসে প্রথম বেসামরিক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই গত ৩ জুলাই বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে মিসরীয় সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আদলি মানসুরকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। বর্তমানে মুরসিকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু মিসরের মুসলিম ব্রদারহুডের সমর্থকরা এখনো তাকে ক্ষমতায় পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন-বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। এরই মধ্যে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে ৮০ জনের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়া মিসরে ব্রাদারহুডের রক্তাক্ত ইতিহাসে আরো রক্তের দাগ লাগবে সামনের দিনগুলোতে। তথ্যসূত্র : আইআরআইবি, প্রেসটিভি, উইকিপিডিয়া