চশমায় খোঁজ ব্রিটিশ সেনা যোগেন্দ্রর
আর সেই ইতিহাসেই খোঁজ মিলল প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক বাঙালির। যোগেন্দ্র সেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্য, সহকর্মীদের কাছে আদরের ‘জন’। এত দিন জানা ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের লিডস ব্যাটেলিয়নের সদস্য ছিলেন যোগেন্দ্র। বৃটেনের হয়েই লড়তে গিয়ে মারা যান তিনি। তখন তার বয়স মাত্র আঠাশ। কিন্তু এ সবের মধ্যে নতুন তথ্য কোথায়- এ প্রশ্ন করলে ইতিহাস্বিদদের একাংশ বলবেন “রয়েছে।” কারণ তাদের অনুমান, বৃটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে লড়তে গিয়ে যে সব বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম যোগেন্দ্রই। একশো বছরের আড়াল সরিয়ে এই তথ্যের হদিস দিয়েছে একজোড়া চশমা। যোগেন্দ্রর চশমা। যার কাচের অংশে শুকনো রক্তের দাগ এখনও স্পষ্ট।
এই ‘আবিষ্কার’-এর পিছনে বড়সড় কৃতিত্ব রয়েছে আর এক বঙ্গসন্তানের। নাম শান্তনু দাস। লন্ডনের কিংস কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শান্তনুই সর্বপ্রথম চন্দননগরের এক জাদুঘরে ওই চশমাজোড়ার খোঁজ পেয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল আরও কিছু জিনিসপত্র। সবক’টিই যোগেন্দ্রর। আসলে চন্দননগরে আদি বাড়ি ছিল তার। সে সূত্রে সেখানকার জাদুঘরে স্থান পেয়েছিল চশমাজোড়া। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেয়ার সময় সেই চশমাজোড়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন শান্তনু।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে যখন লিডস ‘প্যালস’ ব্যাটেলিয়ন গঠন হয়, তখন তাতে তীব্র উৎসাহ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন যোগেন্দ্র। ফিফটিন্থ ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ সদস্য ছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি চলেছিল লেখাপড়াও। লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-ও পাশ করেন যোগেন্দ্র। যোগ্যতা ও উৎসাহ দুই-ই ছিল এই বাঙালি তরুণের। কিন্তু তার পরও বৃটিশ সেনাবাহিনীতে ‘অফিসার’ হওয়া হয়নি। স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বর্ণবৈষম্য। সে কথা পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যোগেন্দ্রর সহকর্মী আর্থার ডলবিও। ১৯৮৮ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আর্থার বলেন, “ব্যাটেলিয়নে উনিই সবচেয়ে শিক্ষিত ছিলেন। সাতটা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তার পরেও তাকে ল্যান্স-কর্পোরাল পর্যন্ত করা হয়নি। কারণ সে সময় কোনও কৃষ্ণাঙ্গকে কোনও শ্বেতাঙ্গের উপর কর্তৃত্ব করতে দেয়া হতো না।”
কিন্তু তার পরেও বৃটেনের হয়ে লড়েছিলেন যোগেন্দ্র। প্রশিক্ষণ শেষ করার ২০ মাসের মাথায় মারা যান তিনি। সেনা-ক্যাম্পে থাকার সময় একটা ছবি উঠেছিল তার। সেখানেই দেখা গিয়েছিল চশমাপরা যোগেন্দ্রকে।
ঘটনাচক্রে সেই চশমাই চন্দননগরের জাদুঘরে দেখতে পান শান্তনু। তার বয়ানে, “চশমাজোড়া দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বহু ভারতীয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই ভারতীয় সেনার অংশ ছিলেন। যোগেন্দ্র কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন না, ছিলেন লিডস প্যালস ব্যাটেলিয়নের সদস্য।” একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার, ভেবেই অবাক হন শান্তনু।