হেফাজতের সংবাদ সম্মেলন

রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষে দেশ আজ মহাবিপদে

Hefazotদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত এ সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে হেফাজত নেতা বলেন, আমরা আজ অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে জাতির বিবেক সাংবাদিক ভাইদের সাথে মিলিত হয়েছি। সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষে অচল হয়ে গেছে বাংলাদেশ। তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দলীয় বিভেদে সৃষ্ট হানাহানির আগুনে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম, শহর ও রাজধানীসহ পুরো জনপদে। দুই পক্ষের মারামারিতে দেশ আজ মহাবিপদে পড়েছে। খুনাখুনি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কথিত ‘বন্দুক যুদ্ধে’, ক্রসফায়ারে এবং পেট্রল বোমা হামলায় জীবন যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। গুম করা হচ্ছে জ্বলজ্যান্ত মানুষদের। যত্রতত্র লাশ পড়ে আছে। মসজিদের দুজন নিরীহ নিরপরাধ ইমামকে পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। বিরোধী আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্মমতা ও নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আজ চরমভাবে বিপন্ন। পথে-ঘাটে মানুষ নিশ্চিন্তে চলাচল করতে পারছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও শিাব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশের মানসম্মান ধুলায় মিশে যাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যত সম্ভাবনাও অন্ধকার হয়ে পড়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে সরকার নির্বাচিত না হওয়ায় এই গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে আমরা মনে করি। রাজনৈতিক অহমিকায় আক্রান্তরা সংবিধান থেকে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়ে জাতিকে হানাহানি ও চরম বিভক্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। টানা অবরোধ ও হরতালে দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে আর চলতে দেয়া যেতে পারেনা; দেশবাসী আর মেনে নিতে পারছেনা। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা শান্তি চাই। রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘাত ও মানুষ হত্যার উৎসবের অবসান চাই। তাই সরকার ও বিরোধী পক্ষকে সতর্ক করে আমরা বলতে চাই, অবিলম্বে কার্যকর সংলাপের মাধ্যমে কাঙ্খিত সমঝোতা ও ফয়সালায় আসুন; অন্যথায় দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তির জন্য যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবেনা।
রাজনৈতিক লড়াইয়ে ক্ষমতার স্বার্থে আজকে সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষ বিদেশি প্রভুদের কাছে-টানার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাদের এহেন মানসিকতা একটি স্বাধীন জাতির জন্য খুবই অমর্যাদাকর। ভিনদেশিদের গোলাম হওয়ার জন্য লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়নি। স্বাধীনতাপ্রিয় আলেমসমাজ ও তৌহিদি জনতা আত্মসম্মানহীন এমন নেতৃত্ব ও রাজনীতি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। কোনো ছলাকলায় বিদেশি শক্তির আগ্রাসন ও অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দেশকে ইরাক-আফগানিস্তান বানানোর চক্রান্ত করা হলে তার দায়-দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকেই বহন করতে হবে।
বক্তারা আরো বলেন, আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করছি যে, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে ভিন্ন দিকে ফেরানোর জন্য নতুন করে নিরীহ আলেমসমাজ ও কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের জড়িয়ে কথিত অস্ত্র উদ্ধার ও গ্রেপ্তার নাটক তৈরি করে জঙ্গিবাদের কল্পকাহিনী সাজানো হচ্ছে। একশ্রেণির চিহ্নিত মিডিয়া ও একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর যৌথ কারসাজিতে এর আগেও অসংখ্যবার এমন অপপ্রয়াস আমরা লক্ষ করেছি। জঙ্গিবাদের জিগির তুলে তারা দেশের আলেমসমাজ ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিকদেরকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কলঙ্কিত করতে এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করতে নানা ধরনের মিথ্যা অভিযান ও নাটক বানিয়ে থাকে। বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলোকে ‘জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র’ বলে অপপ্রচারণা এবং সময় বুঝে হঠাৎ করে বিভিন্ন মাদ্রাসায় পুলিশের অভিযানপূর্বক কথিত জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার ও কোরআন-হাদিস সম্পর্কিত সাধারণ ইসলামী বইসমূহকে ‘জিহাদী বই’ বলে মিডিয়ায় উপস্থাপনÑএর সবই দেশের আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র; এতদসত্ত্বেও দেশের কোনো কওমী মাদ্রাসায় জঙ্গিবাদের দীক্ষা ও ট্রেনিং দেওয়া হয়Ñএমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আদৌ কেউ দেখাতে পারেনি। সুতরাং দেশের আলেমসমাজ ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে কলুষিত করার অব্যাহত ষড়যন্ত্র বন্ধ করার আহবান জানাচ্ছি।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও সমকালীন যাবতীয় ফিতনা ইসলাম সমর্থন করেনা। আর ইসলাম সমর্থিত নয় এমন কোনো কিছুই কওমী মাদ্রাসাশিক্ষা ধারণ করে না। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় যারা পড়াশোনা করেন, তারা বর্তমান ভোগবাদী পুঁজিবাদী দুনিয়ার যান্ত্রিক ক্রীতদাসে পরিণত হন না। বিনয়, নৈতিকতা, ধর্মীয় আদর্শ ও তাওহিদের জ্ঞান সাধনাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। কর্পোরেট দুনিয়ার সেবাদাস নয় বলেই আজকে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ও আলেমসমাজের বিরুদ্ধে যত অপপ্রচারণা ও নানাবিধ ষড়যন্ত্র চলছে।
বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় কতিপয় ইসলামবিদ্বেষী মুরতাদ ও নাস্তিক মন্ত্রী রয়েছে, যারা ইসলামী বিধিবিধান ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিদ্বেষপ্রসূত মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধান পর্দা বা হিজাব পরাকে কটাক্ষ করে ইতোপূর্বে মূর্খ সমাজকল্যাণমন্ত্রী ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছে। ‘সুদে’র মতো আল্লাহ প্রদত্ত হারাম বিধানকে অবৈধ নয় বলে ফাসেক অর্থমন্ত্রী পবিত্র কোরআনের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে উপর্যুপরি আঘাত করে তারা আলেমসমাজ ও তৌহিদি জনতাকে ক্ষিপ্ত করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চায়। এদেরকে প্রতিরোধ করা আমাদের সকলের ঈমানি দায়িত্ব। এইসব ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক-মুরতাদ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমরা দেশের সর্বস্তরের ওলামা-পীর-মাশায়েখ ও তৌহিদি জনতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
কোরআন সুন্নাহ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চার ফলে দেশের জনগণ আজ আল্লাহর কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে ফিরে আসা ছাড়া এই ক্রান্তিকাল ও সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। মহান আল্লাহ তা’য়ালার অসীম রহমত ও মেহেরবানি ছাড়া এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা যাবে না। তাই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশ ও ঈমান বাঁচাতে সবাইকে একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শক্তি দিন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হেফাজত করুন।
বুধবার বেলা সাড়ে এগারটায় এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের নেতারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবু নগরী, মহাসচিব আল্লামা জোনায়েদ বাবুনগরী, কেন্দ্রিয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী , মাওলানা মাহমুদুল হাসান, কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। হেফাজতের কেন্দ্রিয় কার্যালয় হাটহাজারীতে এ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন মহাসচিব আল্লামা জোনায়েদ বাবুনগরী। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
হেফাজতের কর্মসূচী: রাজনৈতিক সহিংসতা ও ক্রসফায়ারে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত এবং পেট্রল বোমার আগুনে দগ্ধ ও আহতদের সুস্থতা কামনায় দেশের সকল মাদ্রাসা ও মসজিদে নিয়মিত দোয়ার এন্তেজাম করা।
দেশের সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ তা’য়ালার সাহায্য কামনায় সকল মাদ্রাসা ও মসজিদে কুনুতে নাজেলা পড়ার ব্যবস্থা করা।
আগামী ৯ ও ১০ এপ্রিল, ২০১৫ চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে দুই দিনব্যাপী শানে রেসালাত সম্মেলন, ১৭ এপ্রিল ফেনী জেলার মিজান ময়দানেএবং ২৭ ও ২৮ মার্চ, ২০১৫ কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে দুই দিনব্যাপী শানে রেসালাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button