শেষ জীবনের একাকিত্ব

Al Mahmudরমজান মাহমুদ: দুপুর ২:৩০ মিনিট। মগবাজার ওয়্যারল্যাস মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর লেখক ফোরামের সভাপতি ইকবাল হোসাইন ইকুর সাথে তরুণ ছড়াকার ও গাল্পিক আবিদ আজমের জন্য। উদ্দেশ্য কবি আল মাহমুদের সাথে সাক্ষাৎ। অল্প সময়ের ভেতর আবিদ আজম এসে উপস্থিত হলেন। আমরা যথারীতি কবির বাসায় যাত্রা শুরু করলাম। ঘরের ভেতর ছিমছাম নিরবতা, আবছা অন্ধকার বিরাজমান। আমরা এক পা দু’পা করে সামনে অগ্রসর হলাম। কবি তখন শোয়ার ঘরের বিছানায় বসে আছেন। সম্ভবত একটু আগে দুপুরের খাবার শেষ করেছেন। দুপুরের সময় হওয়াতে আমাদেরকেও খাবার পরিবেশন করা হলো। মহরমের দিন, তাই বাসায় খিচুড়ি রান্না হয়েছে। আজম আমাদেরকে নিয়ে খাবার ঘরে গেলেন। আমরা পরম তৃপ্তিতে দুপুরের খাবার শেষ করলাম। আজম বলল, একটু বিশ্রাম নেন তারপর মাহমুদ ভাইয়ের সাথে কথা বলবো। আমরা কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম। তারপর কবির শোয়ার রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। মাহমুদ ভাই শুয়ে আছেন। আজম তাকে ডেকে ওঠালেন। খুব কষ্টে বিছানায় ওঠে বসলেন। বয়স হয়েছে না ! আমাদের দেখে বললেন, আমি খুব অসুস্থ। কবির কথায় তা স্পষ্টত ফুটে ওঠেছে। অনেক কষ্টে আমাদের সংগঠনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তৈরিকৃত বিবৃতিতে তিনি স্বাক্ষর করে দিলেন। আমাদের সাথে বেশ কিছু সময় তিনি হাসি মুখে নিরবে কথা বললেন।
সংগঠনের সার্বিক ব্যাপারগুলো খুব মনযোগ সহকারে শুনলেন। আমার কাছে মনে হলো এই তো সেদিন কবি ছুটে বেড়িয়েছেন শহর থেকে গ্রামান্তরে। আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বিউটি বোর্ডিং পার করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক সময় কবি,সাহিত্যিক, সাংবাদিকও সাংস্কৃতিক কর্মীদের পদচারনায় মুখর হয়ে ওঠতো বিউটি বোর্ডিং। আড্ডায় ভরে উঠত সে দিনগুলি। আড্ডায় অংশ নিতেন শহীদ কাদরি, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, হেলাল হাফিজ, বেলাল চৌধুরী ও রাবেয়া খাতুনসহ অনেকে। তুমুল আড্ডা জমে ওঠত নিজেদের মধ্যে। কখনও কখনও আড্ডার মূল শিরমনি থাকতেন তিনি।  তখন তার চারপাশে থাকতো অনেক শুভাকাঙ্খী। যারা এক মুহূর্তের  জন্যেও তার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইতেন না। অথচ আজ পড়ে আছেন বিছানায় ! কখনও সুস্থ, কখনও বা অসুস্থ শরীর নিয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন চার  দেয়ালের একটি রুমে। যেখানে পরিবারের লোকজন ব্যতীত বাহিরের পরিচিত জনরা খুব একটা যান না তার সান্যিধ্যে। মানুষের জীবনের শেষ দিনগুলো কি এভাবেই অতিবাহিত হয়? শেষ জীবন কী এভাবেই চরম একাকিত্বে কাটে ! এসময় বন্ধু হয়ে কেউ হাত বাড়িয়ে সামনে আসে না। জীবনের পড়ন্ত বেলার সময়গুলো খুব ভয়ানক হয়ে থাকে। কবির এ অবস্থা দেখে আমার  বারবার মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতার কথা। যেখানে কবির সোনার ধানের জায়গা হচ্ছে ঠিক কিন্তু সে তরীতে তার জায়গা হচ্ছে না। মাহমুদ ভাইয়ের কবিতার মূল্যায়ন হচ্ছে ঠিক কিন্তু ব্যক্তি আল মাহমুদের মূল্যায়ন হচ্ছে না। আমাদের সমাজে এটাইতো এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। জীবদ্দশায় আমরা কাউকে মূল্যায়ন করতে জানি না। তাকে মূল্যায়ন করা হয় ঠিক-ই কিন্তু তা মৃত্যুর পর। আমরা কি পারি না আমাদের এ সংস্কৃতির আদৌ পরিবর্তন করতে? একটু ইচ্ছে করলেই হয়তো বা তা করা সম্ভব।
কবির বুক  সেলফে অসংখ্য বই সাজানো রয়েছে। কিছু বই নিজের  লেখা কিছু তার সহকর্মীদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে প্রাপ্তি। এছাড়া আলাদা একটি আলমারিতে রয়েছে সারা জীবন যে সব ক্রেস্ট লাভ করেছেন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ। সে গুলোতে এক নজর চোখ বুলালাম। পরিপাটি ভাবে সাজানো, খুব ভালো লাগলো এ গুলো দেখে। কবি শামসুর রহমান ও মাহমুদ ভাইয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের একটি ছবি টানানো রয়েছে সদর দরজা থেকে একটু ভেতরে প্রবেশ করলেই। সব কিছু পরিদর্শন শেষে যখন আবার ফিরে গেলাম মাহমুদ ভাইয়ের কাছে। তখন তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আবিদ তাকে ডেকে ওঠালেন। কিছু সময় একান্তে কথা বললাম। দুপুরে তার বাসায় খেয়েছি কিনা তা জিজ্ঞেস করলেন। আজম মাথা নেড়ে বললেন, হুম খাওয়া হয়েছে। এখন বিদায়ের পালা…….
বিদায় বেলায় বললাম, আসি তাহলে …কবি কিছুই বললেন না। কিছু সময় তাকিয়ে থাকলেন, আমরাও তাকিয়ে আছি তার দিকে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button