দার্জিলিংয়ের দু’শো বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘যামা মসজিদ’ মুসলিম পর্যটকদের আকর্ষণ করছে

Jame masjidশাহেদ মতিউর রহমান, দার্জিলিং (ভারত) ঘুরে এসে: ঐতিহ্যের পাশাপাশি কারুকার্যেও বেশ আকর্ষণীয় দার্জিলিংয়ের ‘যামা মসজিদ’। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান হওয়াতে দেশী-বিদেশী মুসলিম পর্যটকদেরও মূল  আকর্ষণ দু’শো বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ।  দার্জিলিং  শহরের প্রধান বাসস্ট্যান্ড  (টার্মিনাল) কচুরী রোডের দারোগা বাজারের কেন্দ্রস্থলে এই মসজিদ। হিমালয়ের কাছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের উপরে গড়ে উঠা দার্জিলিং শহরে বেড়াতে আসা দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছেও এই মসজিদ বেশ আকর্ষণীয়। বিশেষ করে দার্জিলিং শহরের প্রধান কেন্দ্র মল রোড বা মল মার্কেটের নিকটেই এই মসজিদটির অবস্থান হওয়ার কারণে প্রতি ওয়াক্ত নামাযেও মুসল্লিদের উপস্থিতি থাকে বেশি। মাগরিবের নামাযের পর মুসল্লিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে নামাযে আগত মুসল্লিদের ৫০ ভাগই  পর্যটক। বাংলাদেশসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল ছাড়াও বিশ্বেও অন্যান্য দেশ থেকেও বেশির ভাগ পর্যটক মেঘের রাজ্য  হিসেবে খ্যাত দার্জিলিং শহরে  বেড়াতে আসেন।  শীতের সময়ে (নবেম্বর থেকে জানুয়ারি) দার্জিলিং শহরের গড় তাপমাত্রা থাকে ৬ ডিগ্রিরও নিচে। ফলে মার্চের পরেই এই শহরে পর্যটকদের ভিড় থাকে বেশি। এই সময়ে এখানকার তাপমাত্রা থাকে গড়ে ৯ থেকে ১২ ডিগ্রির মধ্যেই।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো দার্জিলিং শহরের অবস্থান সমুদ্র সমতল হতে প্রায় ৬ হাজার ৬শ’ ৮৬ ফুট (প্রায় ৭ হাজার ফুট) উপরে। ভৌগোলিকভাবে মেঘের রাজ্য বা শহর হিসেবে পরিচিত দার্জিলিং শহরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের  অবস্থান ২৩ দশমিক ০৩ ডিগ্রি উত্তর এবং ৮৮ দশমিক ২৭  ডিগ্রি পূর্বে। এখানকার মোট জনসংখ্যার ৮৯ ভাগই সাক্ষরতা অর্জন করেছেন। যদিও ভারতের  গড় সাক্ষরতার হার ৫৯ ভাগ। সেই অনুসারে দার্জিলিংয়ের সাক্ষরতার হার ভারতের অন্যান্য স্থানের তুলতায় কিছুটা বেশি। এই শহরের নারী এবং পুরুষের হারও সমান সমান। অর্থাৎ ফিফটি ফিফটি।
দার্জিলিং শহরের ও গ্রামের দুই জায়গায় মিলে মোট জনসংখ্যা ১৭ লাখ। এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ। মূল শহরে মুসলমানদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। মুসলমানদের মধ্যে হোটেল রেস্তোরাঁর মালিক বা ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও একেবারেই কম। পর্যটন শহর হওয়ার কারণে দার্জিলিংয়ের অধিকাংশ লোকের প্রধান পেশাই হচ্ছে হোটেল রেস্তোরাঁ পরিচালনা  করা ও রেন্ট-এ কারের ব্যবসা। তবে সনাতন ধর্মের লোকদের  আধিক্যে মুসলমানদের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো নয়। এর মধ্যেও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় দাপটের সাথেই টিকে আছে মুসলমান ব্যবসায়ীরা।
গত ৭ মার্চ থেকে ৯ মার্চ তিনদিনের দার্জিলিং শহর ভ্রমণে  মুসলমান ব্যবাসায়ীদের সাথে  কথা বলে জানা গেল তাদের নানা সমস্যার কথা। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে যেসব পর্যটক দার্জিলিং শহরে ভ্রমণ করতে আসেন তারা না জানার কারণে ভিন্ন ধর্মের লোকদের পরিচালিত হোটেলে  থাকা খাওয়ার ক্ষেত্রে নানা সমস্যার কথাও জানা গেল। প্রতিটি আবাসিক হোটেলে প্রবেশ করতেই দেখা যাবে বিভিন্ন আকৃতির প্রতিমা বা মূর্তি দিয়ে  প্রবেশদ্বার সাজানো রয়েছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে ধুপ জ্বালিয়ে সনাতন ধর্মীয় রীতিতে অতিথি বরণ করে নেয়ারও রীতি চালু রাখা হয়েছে এখানে। তবে বাংলাদেশের মুসলিম পর্যটকদের যারা দার্জিলিং ভ্রমণ করতে যাবেন তাদের প্রথমেই কাজটি হবে দার্জিলিংয়ের মুসলিম হোটেলগুলোর নাম ঠিকানা জেনে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করা ও খাওয়া-দাওয়া করা।
আঞ্জুমানে ইসলামীর পরিচালনায় ও তাদের বরাদ্দ দেয়া প্রায় দশ লাখ টাকায়  সদ্য সংস্কার করা যামা  মসজিদের কাজ শেষ হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। শীতপ্রধান হওয়ায় এই মসজিদের বিশেষত্ব হলো মসজিদের মেঝে তৈরি করা হয়েছে পুরোটাই কাঠ দিয়ে। ফলে অধিক শীতেও মসজিদের মেঝে ঠা-া হয় না।  অতিরিক্ত ঠা-ায় মুসল্লিদের আরামের কথা বিবেচনা করেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরেও মসজিদের ভেতর-বাইরে পুরো মেঝেতেই মোটা কার্পেট ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের বাইরে অজুর পানি সবসময়ই গরম করে রাখারও ব্যবস্থা আছে।
যামা মসজিদের  নিয়মিত একজন  স্থানীয় মুসল্লি সাবদার আলী। বয়স ৪৭ বছর। তিনি জানালেন, একজন মুসলিম হয়ে বেড়াতে এসে থাকা এবং খাওয়ার বিষয়ে আমাদের আরো বেশি সচেতন হওয়া দরকার। বিশেষ করে খাওয়ার জন্য অবশ্যই হারাম-হালালের মতো বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। তবে না জানার কারণে অনেক মুসলিম পর্যটক ভাই-বোনেরা দার্জিলিংয়ের অমুসিলম পরিচালিত হোটেল রেস্তোরাঁয় অবস্থান করেন। ফলে অনাকাক্সিক্ষত অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
সাবদার আলী  আরো জানালেন, দার্জিলিংয়ের মূল কেন্দ্রস্থলে বেশ কয়েকটি মুসলিম হোটেল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে হোটেল সোসাইটি শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এছাড়াও মোমিন হোটেল ও প্রিন্সেস হোটেলটি মুসলিম পর্যটকদের জন্য বেশ উপযোগী। ভাড়াও বেশ কম। তবে চাহিদামতো এসব হোটেলে এসি, নন এসি, ডিলাক্স ও ডাবল ডিলাক্স রুমও ভাড়া পাওয়া যায়। পাহাড়ি পথ হওয়াতে  পায়ে হেঁটে চলাচল করাও অনেক কষ্টসাধ্য। তাই মসজিদের কাছে হোটেল হলে নিয়মিত নামায পড়ার ক্ষেত্রেও বেশ সুবিধা পাবেন মুসলিম পর্যটকরা। এছাড়া যামা মসজিদের পাশ থেকেই টাইগার হিল (যেখান থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়), চা বাগান, ট্রয় ট্রেন স্টেশন, মল মার্কেট, বাতাসিয়া লোপ (ওয়ার মেমোরিয়াল)  ঘুম মন্দির, রক গার্ডেন, জাপানীজ টেম্পল, পিচ পেগোডা, চিড়িয়াখানা, হিমায়ল মাউন্টেইনিং ইনস্টিটিউট, রোপওয়ে, টেনজিং রক, মল মার্কেট ও মিরিক যাওয়ার ভাড়ায় টেক্সি ও শেয়ারে জিপও অল্প দূরত্বেই পাওয়া পায়। এছাড়া স্থানীয় খাবার-দাবার ও দার্জিলিংয়ের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ভ্রমণ করতে হলেও যামা মসজিদের পাশ থেকেই যেকোন স্থানে  সহজেই ও  স্বল্প খরচে যেতে পারেন পর্যটকরা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button