বিশ্বশক্তি যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়ে নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে
সিরীয়দের রক্ষায় জাতিসংঘ ব্যর্থ
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার নাগরিকদের রক্ষা ও তাদের সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। দেশটিতে কাজ করে এমন বিশ্বের ২১টি বড় ত্রাণ সংস্থার এক যৌথ প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। বুধবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম সেভ দ্য চিল্ড্রেন ও অক্সফার্ম জানায়, যুদ্ধের পাঁচ বছরের মধ্যে জনগণের জন্য ২০১৪ সাল ছিল সবচেয়ে খারাপ বছর।
একই দিনে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৃহযুদ্ধ শুরুর পর সিরিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এই অভিযোগের জবাবে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফানে ডিজুয়ারিক জানান, বিশ্বশক্তিগুলো সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়ে নিজেদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। তিনি আরো জানান, জাতিসংঘ এখনো দেশটিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের ওপর আস্থা রাখছে এবং এ ব্যাপারে বিশ্বশক্তিগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছে।
অন্য একটি সংস্থার মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর সিরিয়ার ৮৩ শতাংশ অঞ্চলে কোনো বিদ্যুৎ সুবিধা নেই। অনেকে ত্রাণের অভাবে ভুগছেন। ওই দাতব্য সংস্থার একটি নরওয়েজিয়ান শরণার্থী কাউন্সিলের মহাসচিব জ্যান ইজিল্যান্ড বলেন, সিরিয়ার বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের দেয়া প্রস্তাব বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়া একটি খারাপ বাস্তবতা। সিরিয়ায় সহিংসতায় লিপ্ত সব পক্ষ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অবজ্ঞা ও দায়মুক্তি হিসেবে দেখেছে। বেসরকারি নাগরিকদের রক্ষা ও তাদের বিশ্বাসের কোনো উন্নতি হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে ২০১৪ সালে ৭৬ হাজার লোক নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পাঠানো ত্রাণ দেশটির ৪৮ লাখ লোকের কাছে পৌঁছানো বেশ কঠিন হচ্ছে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ লাখের মতো। শিশুদের সাহায্য চাহিদা ২০১৩ সালের চেয়ে ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চার বছরের গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার ৮০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে।
জাতিসংঘ সমর্থিত সিরিয়ান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিনের সংঘাতে দেশটির ২০ হাজার কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া পাঁচ বছরে পা রাখা গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির সম্পদ, অবকাঠামো, প্রতিষ্ঠান এবং কর্মশক্তি ধ্বংস হচ্ছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালে আসাদবিরোধী তৎপরতার কারণে সৃষ্ট সংঘাত শুরুর পর থেকে দেশটিতে ৩০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে। এ সময় দেশটিতে বেকারত্ব বেড়েছে ৪২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১১ সালে দেশটিতে বেকারত্বের হার ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৪ সালের শেষে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশে। এ ছাড়া চলমান সহিংসতার কারণে দেশটির জনসংখ্যা কমেছে ১৫ শতাংশ। ২০১০ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল দুই কোটিরও বেশি। গত বছরের শেষে তা ছিল এক কোটি ৭০ লাখের সামান্য বেশি। এ ছাড়া শরণার্থীর সংখ্যার দিক থেকেও ফিলিস্তিনের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে সিরিয়া। প্রতিবেদনটি বলছে, দেশটির অন্যান্য খাতের সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাও।
সিরিয়া সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা তাদের হাতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। কিন্তু সেই সমস্যা কবে সমাধান হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি। দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে সিরিয়ায় মানবিক অবস্থা একেবারে খাদের কিনারে পৌঁছাবে এবং মানবজীবনে এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
এ ছাড়া বুধবার ‘উইথসিরিয়া’ নামে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একটি জোট স্যাটেলাইট থেকে তোলা বেশকিছু ছবি প্রকাশ করে বলেছে, গত চার বছরে রাতের সিরিয়ায় মহাশূন্য থেকে দৃশ্যমান আলোর পরিমাণ ৮০ শতাংশ কমে গেছে। তারা বলেছে, এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে, ব্যাপক হারে অবকাঠামো ধ্বংস হওয়া।
৪ বছরে ৬১০ চিকিৎসক নিহত: এদিকে সিরিয়ায় বাসার আল আসাদের বাহিনীর হাতে বিগত চার বছরে ৬১০ ডাক্তার ও মেডিকেল কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। বুধবার ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া আসাদ সর্বশেষ কৌশল হিসেবে ডাক্তার ও মেডিকেল কর্মকর্তাদের হত্যার ছক করেছিলেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী তার বাহিনী ১৮৩ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ২৩৩টি হামলা পরিচালনা করেছে। নিহতদের মধ্যে ১৩৯ জনকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাশারের বাহিনী। চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের মৃত্যুর জন্য আসাদ-বাহিনীকে ৯৭ শতাংশ দায়ী করেছে জাতিসংঘ সদর দফতর।