৪০ লাখ পাউন্ড তহবিল সহায়তা
পূর্ব লন্ডনে বিশ্বের বৃহত্তম ‘সম্প্রদায়গত জিন গবেষণা’ শুরু
ইস্ট লন্ডন জিন্স এন্ড হেলথ এ বিশ্বের বৃহত্তম সম্প্রদায়ভিত্তিক জিনগত গবেষণা শুরু হয়েছে। এই গবেষণার লক্ষ্য, এক লাখ স্থানীয় বাসিন্দার জিন পরীক্ষা করে পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন।
কুইনমেরি ইউনিভার্সিটি এই গবেষণার নেতৃত্ব দেবে। গবেষণাকার্যটি পরিচালনা করতে ওয়েলকাম ট্রাস্ট এবং এমআরসি ৪০ লাখ পাউন্ড (৪মিলিয়ন পাউন্ড) তহবিল সহায়তা দিয়েছে। গবেষকরা স্থানীয় দক্ষিণ এশিয় বংশোদ্ভূত মানুষদের জেনেটিক কোড এবং মেডিকেল রেকর্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। তাদের লক্ষ্য, রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে জিন এবং পারিপার্শিক বিষয়গুলোর প্রভাব নির্ণয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য স্থানীয় মানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। বিশেষ করে স্থানীয় বাসিন্দারা এবং ব্যাপকসংখ্যক জনগোষ্ঠী যেসব রোগে আক্রান্ত হন যেমন- হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মত ব্যাপক মানুষকে আক্রান্তকারী রোগের চিকিৎসার কার্যকর উন্নয়নে প্রতিষেধক তৈরিতে সহায়তা করবে।
ব্রিটেনের মধ্যে পূর্ব লন্ডনের বারাগুলোতে, বিশেষ করে বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানী কমিউনিটির লোকদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল স্বাস্থ্য লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় :
পকিস্তানী বংশোদ্ভূত পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার ব্রিটেনের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং দক্ষিণ এশিয়ান সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে হৃদরোগের কারণে কম বয়সে মৃত্যুর ঘটনা সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় দ্বিগুণ।
দক্ষিণ এশিয়ার বংশোদ্ভূত লোকদের মধ্যে টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় পাঁচগুণ বেশি।
লন্ডনের বারাগুলোর মধ্যে টাওয়ার হ্যামলেটস এবং নিউহামে মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে কম।
কুইনমেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের এই গবেষণার সহ নেতৃত্বদাতা অধ্যাপক ডেভিড বেন হীল বলেন, ইস্ট লন্ডন জিন্স এন্ড হেলথের সামগ্রিক লক্ষ্যই হলো স্থানীয় মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন। শুধু এমন নয় যে, যুক্তরাজ্যে দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত মানুষদের মধ্যে দুর্বল স্বাস্থ্যের হার সবচেয়ে বেশি; চিকিৎসা গবেষণায়ও এরা উল্লেখযোগ্যভাবে অবহেলিত। যে কারণে জিনগত জ্ঞান ভবিষ্যৎ চিকিৎসার মূলমন্ত্র হয়ে উঠলেও এসব কমিউনিটি তা থেকে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমরা এমন প্রবণতার পরিবর্তন করতে চাই এবং তা করার জন্য আমাদের প্রয়োজন স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতা।
স্থানীয়ভাবে এক লক্ষ লোকের জিনগত নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভালস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আমরা পূর্ব লন্ডনের বাসিন্দাদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার সুযোগ করে দিচ্ছি। পাশাপাশি বিশেষ কিছু লোক কেন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সেই বিষয়ে আমাদের ধারণাগত উন্নতি ঘটাতে পারবো এবং এর উন্নত চিকিৎসা ও প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে পারবো।
গবেষণাকাজে সহায়তা করার জন্য স্বাস্থ্যবিষয়ক পেশাজীবী, ধর্মীয় নেতা এবং স্থানীয় কাউন্সিল সদস্যসহ ৪৬ জনকে ইতোমধ্যে এ কাজে যুক্ত করা হয়েছে। বার্টস হেলথ এনএইচএস ট্রাস্ট এবং স্থানীয় দাতব্য সংগঠন সোশ্যাল একশন ফর হেলথের সাথে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে কুইনমেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এখন ১৬ এবং তার চেয়ে বেশি বয়সী যারা স্বেচ্ছায় নমুনা প্রদানে ইচ্ছুক, তাদের তালিকা প্রণয়ন শুরু করবে। টাওয়ারহ্যামলেটস, ওয়ালথাম ফরেস্ট, নিউহাম এবং এর বাইরের এলাকাগুলো থেকে এসব অংশগ্রহণকারী নেয়া হবে। যারা নিজেদের বাংলাদেশী বা ব্রিটিশ বাংলাদেশী অথবা পাকিস্তানী বা ব্রিটিশ পাকিস্তানী মনে করেন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক, তারা এই গবেষণায় অংশ নিতে পারবেন। যাদের স্বাস্থ্য সমস্যা আছে কিংবা স্বাস্থ্য সমস্যা নেই সকলের জন্যই এই গবেষণা উন্মুক্ত থাকবে।
গবেষণায় অংশ নিতে রাজি এমন সম্মতি দেয়ার পর স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের লালা বা থুতুর নমুুনা সরবরাহ করবেন। যার ওপর পরীক্ষ চালিয়ে স্বেচ্ছাসেবীর জিনগত তথ্য সংগ্রহ করা হবে এবং তা সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবীর মেডিকেল রেকর্ডের সাথে মিলিয়ে দেখা হবে। গবেষণায় অংশগ্রহণের কাজটি অত্যন্ত গোপনীয় এবং অংশগ্রহণকারীর পরিচয় প্রকাশ পায় এমন কোনো তথ্য, যেমন নাম এবং ঠিকানা কোনোভাবে কারো কাছে সরবরাহ করা হবে না।
অধ্যাপক ভেন হীল আরো বলেন, সম্পূর্ণ গোপনীয়তার বিষয়টি ছাড়াও এই গবেষণার সবচেয়ে ভাল দিকটি হলো এতে অংশগ্রহণ করা খুব সহজ। গবেষণায় অংশ নিতে আপনি আপনার স্থানীয় জিপি সার্জারি, মসজিদ কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে যেতে পারেন অথবা আমাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার ঠিকানায় একটি প্যাক পাঠানোর কথা জানাতে পারেন, এতে আপনি ঘরে বসে একান্ত নিজের মত করে নমুনা প্রদান করতে পারবেন। এটা শুধুমাত্র একটি টিউবে খানিকটা থুতু ফেলা এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া। কিন্তু এই সামান্য কাজটি করার মাধ্যমে আপনি আপনার স্থানীয় এলাকার এবং বাইরের নতুন প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যত চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখবেন। স্থানীয়ভাবে এ পর্যন্ত যে সহযোগিতা আমরা পেয়েছি, তা চমৎকার। এখন আমাদের দরকার এই গবেষণার বিষয়টি মানুষের কাছে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া।
কুইনমেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্বাস্থ্যবিষয়ের উপাধ্যক্ষ বলেন, আমরা প্রতিদিনই পূর্ব লন্ডনে নবায়নের (রিজেনারেশনের) ইতিবাচক দিকগুলো দেখতে পাচ্ছি, যেমন ২০১২ সালের অলিম্পিক কিংবা ক্রসরেইল উন্নয়ন। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে আমাদের পূর্ব লন্ডনের স্বাস্থ্যের রিজেনারেশন প্রয়োজন। ইস্ট লন্ডন জিনস এন্ড হেলথ প্রকল্পটি শুরু করা কুইনমেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের জন্য একটি মাইলফলক। কিন্তু আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এই প্রকল্পটির ভাগিদার শুধু আমরা নই; বরং এটা পূর্ব লন্ডনের সকল কমিউনিটির।
এই প্রথমবারের মত স্বতন্ত্র দুটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বিশাল মাপের জিনগত গবেষণা শুরু হয়েছে। এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে অধিকতর স্বাস্থ্যগত উদ্বেগ রয়েছে এবং এদের জিনগত গঠনে উল্লেখযোগ্য তারতম্যের সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস শুধু এটুকুতে সীমাবদ্ধ নয় যে, এই গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য স্থানীয় মানুষদের সাথে ব্রিটেনের বাকী জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যগত অসাম্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; বরং আমরা আশা করছি, এই গবেষণা মানুষের জিন এবং প্রচলিত রোগের মধ্যে সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করবে, যা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
ইস্ট লন্ডন জিন্স এন্ড হেলথ গবেষণাটি দুই ধাপে সম্পাদিত হবে। প্রথম ধাপ চলবে আগামী চার বছর। এই সময়ে এক লক্ষ অংশগ্রহণকারীর নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এরপর দ্বিতীয় ধাপ চলবে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত। এই পর্যায়ে সংগৃহীত উপাত্তগুলোকে স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চিকিৎসা গবেষণায় সহায়তার কাজে ব্যবহার করা হবে। এই ধাপে প্রয়োজনে কিছু নমুনা সরবরাহকারীকে আরো গবেষণার জন্য ডাকা হবে।
এই গবেষণার লক্ষ্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে আমাদের ধারণার উন্নয়ন :
ঔষধের আচরণ : কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা কী কারণে ঔষধের মারাত্মক বৈপরিত প্রতিক্রিয়ায় ভোগান্তির শিকার হয় এবং এর সাথে জিনগত কোনো কারণ জড়িত কি-না?
ডায়াবেটিস : মানুষ চিকিৎসার প্রতি কেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তা জানা এবং বিরল প্রকৃতির ডায়াবেটিস-এর ভিন্ন উপায়ে চিকিৎসা করা যায় কি-না।
হৃদরোগ : কী কারণে হৃদরোগ এবং স্ট্রোক হয়, সেই সম্পর্কে ভালো ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে উচ্চ ও নিম্ন কলেস্টেরল সম্পন্ন মানুষদের জিন পরীক্ষা করা।
জিনগত তারতম্য : বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানী কমিউনিটির প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের মধ্যে ব্যক্তি ভেদে জিনগত তারতম্য কেমন এবং জিনগত সাদৃশ্যের প্রকৃতি নির্ণয়।
নক আউট জিন : যখন কোনো সুস্বাস্থ্যবান ব্যক্তির মধ্যে একই জিন-এর দুটি কপি থাকে (পিতা এবং মাতা উভয়ের জিনপ্রাপ্ত হয়), তখন তা স্বাভাবিক অবস্থার চাইতে ভিন্নভাবে কাজ করে। এই তথ্যটি কীভাবে ঔষধ উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় কাজে লগানো যায় এবং নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার করা যায়।
ইস্ট লন্ডন জিন্স এন্ড হেলথ অন্যান্য ধারাবাহিক জিনগত গবেষণাগুলো থেকে আলাদা, কারণ এটা যুক্তরাজ্যের এমন দুটি স্বতন্ত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করবে, যাদের মধ্যে বিশেষ ধরনের জিনগত পার্থক্য রয়েছে, তারা ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অবহেলিত এবং এই গবেষণা স্থানীয় এনএইচএস-এর ইলেকট্রনিকেলি সংরক্ষিত মেডিকেল রেকর্ডগুলো পর্যালোচনা করবে।
বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানী মানুষের মধ্যে জিনতগত সাধারণ তারতম্যগুলো কি- সেই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান প্রসারিত করার জন্য জিনগত পার্থক্যের গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা বংশগত রোগগুলোর উপসর্গ চিহ্নিত করতে আমাদের জন্য সহায়ক হবে। এছাড়া, গবেষকদল নক আউট জিনগুলোর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে বুঝার চেষ্টা করবেন, এই জিনগুলো স্বাস্থ্যের প্রতি কীভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে (যেমন কলেস্টরেল নিম্নপর্যায়ে রাখা)। এসব গবেষণার মাধ্যমে গবেষকরা আশা করছেন, তারা এমন চিকিৎসা ব্যবস্থা কিংবা ঔষধ আবিষ্কারে সক্ষম হবেন, যা মানুষের ক্ষতিকর জিনগুলোকে দমিয়ে রাখবে এবং ভাল জিনগুলোকে প্রসারিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। সাধারণত মানুষের মধ্যে নক আউট জিন এর উপস্থিতি বিরল। তবে কারো পিতা-মাতা একই বংশের কিংবা পরষ্পর আত্মীয় হলে তার মধ্যে এই জিন-এর উপস্থিতির সম্ভাবনা বেশি থাকে। যা বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকটা প্রচলিত।
ইস্ট লন্ডন জিন্স এন্ড হেলথ গবেষণায় কিভাবে অংশ নেয়া যাবে অথবা এই গবেষণা সম্পর্কে আরো তথ্য জানতে ভিজিট করুন www.genesandhealth.org