তিন মামাকে চেনাই কাল হলো সাঈদের
ওয়েছ খছরু: টাকার জন্যই খুন করা হয়েছিলো সাঈদকে। আমাদের চিনে ফেলায় গলাটিপে তাকে খুন করি। খুনের আগে আমাদের পরিকল্পনার কথা জেনে যায় সে। আমাদের পায়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চায়। কাউকে এ অপহরণের কথা বলবে না বলেও জানায়। কিন্তু নিজেদের রক্ষা করতে আমরা তাকে গলাটিপে হত্যা করি। এরপর লাশ গোপন রাখতে পরপর ৭টি বস্তার ভেতরে বন্দি করে রেখে দেই।
এভাবে ১৬৪ ধারায় স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে ঘাতক পুলিশ কনস্টেবল এবাদুল হক। গতকাল মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতে বিকাল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত এই স্বীকারোক্তি দেয়া হয়।
ফুলের মতো নিষ্পাপ স্কুলছাত্র আবু সাঈদ। ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া এক স্কুলছাত্র। সিলেট নগরীর রায়নগর দর্জিবন্দ বসুন্ধরা ৭৪ নং বাসার মতিন মিয়ার ছেলে সে। গত বুধবার দুপুরে সিলেটের পুলিশ কনস্টেবল এবাদুল, জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক রকিব ও র্যাবের সোর্স গেদা মিয়া এই তিনজন মিলে তাকে অপহরণ করে। এরপর স্কুলছাত্র আবু সাঈদের পরিবারের কাছে প্রথমে ৫ লাখ এবং পরে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। কিন্তু অপহরণকারী তিন জনকে চিনে ফেলাই কাল হলো সাঈদের। অপহরক ‘তিন মামা’কে চিনে ফেলার কারণেই নিষ্পাপ এই শিশুকে গলাটিপে নির্মমভাবে খুন করে তারা।
সাঈদের পরিবারের সদস্যরা বলেন, গত বুধবার সকাল ১০টার দিকে সাঈদ স্কুলব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে স্কুলে চলে যায়। সেখান থেকে একই এলাকায় মামার বাসার যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেয়। মামার বাসার যাওয়ার পথে তাকে অপহরণ করা হয়। এরপর থেকে সাঈদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। শেষে বুধবার রাতে সাঈদের মামা জয়নাল আবেদীন সিলেটের কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন। সন্ধ্যায় অজ্ঞাত ফোন থেকে জানানো হয় সাঈদকে অপহরণ করা হয়েছে। সে তাদের কাছেই আছে। ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে সাঈদকে ছেড়ে দেয়া হবে। দুই লাখ দিতে পারবেন একথা বলে সাঈদের পরিবার সাঈদকে ফেরত চান। এতে রাজি হয় অপহরণকারীরা।
তারা মুক্তিপণের টাকা হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু সেখানে তাদের পাওয়া যায়নি। টাকা নিয়ে ফের বিমানবন্দর এলাকায় বাইশটিলায় যেতে বলে। ওখানে টাকা নিয়ে গেলে অপহরকদের মোবাইলফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এতে অস্থির হয়ে পড়েন সাঈদের পরিবারের সদস্যরা। তারা পুলিশকেও পুরো বিষয়টি জানালে পুলিশ ফোন ট্রাকিং করে ওই নম্বরটি এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ কনস্টেবল এবাদুলের বলে জানায়।
এরপর শনিবার রাতে এবাদুলকে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথমে কনস্টেবল এবাদুল সবকিছু অস্বীকার করলেও পরে সাঈদকে অপহরণের কথা স্বীকার করে। ঘটনাটি জানাজানির পর রাতে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।
এবাদুলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নগরীর বন্দরবাজার এলাকা থেকে জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময় কোর্টপয়েন্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় র্যাবের সোর্স গেদা মিয়াকে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ বলেন, পুলিশ সদস্য এ কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে কোন ছাড় নেই। যেই হোক সে অপরাধী।
নিহত আবু সাঈদের মামা জয়নাল আবেদীন মানবজমিনকে বলেন, এবাদুল সহ তিনজনই সাঈদের পরিবারের পরিচিত। এলাকার হওয়ায় সাঈদ তিনজনকে মামা বলে ডাকতো। তিনি বলেন, ওরা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে সেটি স্বপ্নেও কল্পনা ছিলো না। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।
এদিকে গতকাল মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক শাহেদুল করিমের আদালতে বিকাল চারটা থেকে ৫টা পর্যন্ত জবানবন্দি দেয় এবাদুল। আদালতে জবানবন্দিতে সে অকপটে অপহরণ ও খুনের কথা স্বীকার করে। এ সময় এবাদুল বলে, ‘অপহরণ করার কথা ছিলো আবু সাঈদের মামাত ভাইকে। ভুল করে তাকে অপহরণ করা হয়। কিন্তু অপহরণ করার পর তাকে ফেরত দেয়ার কোন সুযোগ হয়নি।’
এবাদুল বলে, ‘টাকার জন্যই খুন করা হয়েছিলো সাঈদকে। কিন্তু তাদের চিনে ফেলায় গলাটিপে খুন করি তাকে। খুনের আগে আমাদের পরিকল্পনার কথা জেনেও যায় সাঈদ। এ সময় তাকে খুন না করতে সে বার বার আমাদের পায়ে ধরে। প্রাণ ভিক্ষা চায়। কাউকে এ অপহরণের কথা বলবে না বলেও জানায়। কিন্তু নিজেদের রক্ষা করতে আমরা গলাটিপে হত্যা করি সাঈদকে। এরপর লাশ গোপন রাখতে পরপর ৭টি বস্তার ভেতরে বন্দি করে রেখে দেই।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফয়েজ আহমদ বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া রাকিব ও গেদা আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়নি। তাদের রিমান্ড চাওয়া হবে।