ইইউ ও ব্রিটেনের বিড়ম্বনা

EUপূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ হয়ে গেছে ইউরোপ আর একবার। বিরোধ দেখা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ঘিরে। পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলো ইইউ-এ তাদের সদস্যপদ অটুট রাখতে চাচ্ছে রুশ আগ্রাসনের আশঙ্কার সামনে পড়ে। অন্যদিকে ইউরোপ থেকে বেরিয়ে পড়ার হুমকি শুনিয়ে যাচ্ছে ইউকে। ইউরোপীয় ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন পালাবদলের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার টানা পোড়েনের এই পরিস্থিতি। বৃটেন ইউরোপ থেকে বেরিয়ে গেলে ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে যাবে ফ্রান্স ও জার্মানির হাতে। অন্যদিকে রাশিয়াও নতুন শক্তি ফিরে পাবে। বর্তমানে দুর্বল বৃটেনকে এড়িয়ে চলতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। ইইউ-এ যোগ দিতে আগ্রহী স্কটল্যান্ড আবার হুমকি দিতে শুরু করেছে ইউকে থেকে বেরিয়ে পড়ার। ইংল্যান্ড তো বরাবরই বলে এসেছে ইইউ-এ সদস্যপদে বহাল থেকে সে কোনো সময়ে লাভবান হয়নি। বরং বৃটেন সবসময় সবচেয়ে ক্ষমতাশালী থেকেছে ইউরোপের বাইরে একাকী অবস্থানে থাকাকালেই। বৃটেন ইইউ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার পরিণাম সম্বন্ধে ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জোস ম্যাঞ্জয়েল বারোসোর মন্তব্য হচ্ছে- বৃটেনের মতো এতো বড় দেশ এমন বিচ্ছিন্ন ও একলা চলো মানসিকতা পোষণ করতে পারে- এমন অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো তার হয়নি। ইউরোপের প্রবৃদ্ধির কৌশল নিরূপণে কোনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা ইদানীং বৃটেনের দেখা যাচ্ছে না। বৃটেন রয়েছে প্রান্তিক অবস্থানে। ইউরোপের বাণিজ্য বিষয়ক মতামত নিরূপণে এক সময় নেতৃত্ব দিতো বৃটেন। সেখানেও বর্তমানে বৃটেন প্রান্তিক অবস্থানে। গ্রীসের ভবিষ্যৎ প্রশ্নেও প্রায় অপ্রয়োজনীয় দেখা দিচ্ছে বৃটেন। ইউক্রেনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা সূচক ১৯৯৪ বুডাপেস্ট স্মারকে স্বাক্ষর দিয়েছিল বৃটেন। অথচ ইউমেন সংক্রান্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিভিন্ন সংলাপে অংশ নিচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানি। বৃটেন নয়। বিরোধে জড়িত দু’পক্ষের সঙ্গেই বৃটেন তাল মেলাচ্ছে। একদিকে বৃটেন বলছে, রাশিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য ইউরোপীয় ঐক্য আরো মজবুত হতে পারে। অন্যদিকে একই সময়ে ইউরোপ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্রক্রিয়া শুরুর কথাও বৃটেন শোনাচ্ছে।
ইইউ থেকে লন্ডনের প্রত্যাহারের প্রায় অপরিমেয় ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পড়বে বৃটেনের অর্থনীতি খাতে। ইইউ-এ প্রচলিত নিয়ম-কানুনের কুফল হিসেবে ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে বৃটিশ বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে- এই অজুহাতকেও ইউরোপ-ত্যাগের পক্ষে যুক্তি হিসেবে প্রচার করছে বৃটেন। তারা বলছে, বৃটেন ইইউ ছেড়ে বেরোলে ইইউ-বহির্ভূত অঞ্চলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা আরো গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় বৃটেনকে হারাতে হবে- প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে কিন্তু এর বিপরীত। নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডকে- প্রিয় দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতে চায় বৃটেন তাদের ইইউ বিরোধিতার সমর্থনে। ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ লাভের জন্য বছরে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয় নরওয়েকে।
পাশাপাশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক ইইউ কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সূচক যে কোনো বৈঠকে নরওয়ের মতো সুইজারল্যান্ডকেও সব সময় অপ্রধান ভূমিকা নিতে দেখতে পাওয়া যায়। দুনিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের আর্থিক বাণিজ্যিক স্বার্থেই ‘নাফটা’র ওপর নির্ভরশীল। ‘আসিয়ান’-এর ওপর নির্ভরশীল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলো।
বাণিজ্য, শুল্ক নিয়ম, পেটেন্ট অর্থপাচার ও দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে এবং ভারত, চীন ও দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে নিরাপত্তা প্রশ্নের যথার্থ শক্তি সামার্থ্য নিয়ে ইউকে সম্মুখীন হতে পারে কেবল ইইউ-এর সদস্য পদে বহাল থাকা অবস্থাতেই একক অবস্থান ধরে রেখে নয়- হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সঙ্গে অন্য একটি মন্তব্যও যুক্ত হওয়া উচিত। পরলোকগত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নিবন্ধ লেখক হুগো ইয়ং বলতেন, বৃটেনের সমস্যা হচ্ছে- তার দর্পিত অতীতের স্মৃতি থেকে বৃটেন কোনোভাবেই বেরিয়ে আসতে পারছে না- অথচ ভবিষ্যৎকে উপেক্ষা করে চলাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
বৃটিশ নেতৃত্বের সংঘবৈরী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে ইউরোপ বিরোধী ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির বক্তব্যে সম্প্রতি। দলটির জনপ্রিয়তা জনমত জরিপে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। জনগণের আর্থিক অভাব অভিযোগ ব্যবহৃত হচ্ছে দলটির ইউরোপ বিরোধী প্রচারণায় প্রধান সম্বল হিসেবে। বৃটেনে আগত ও কর্মরত বিদেশী ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে দলটি। সর্বোপরি সারা ইউরোপকেই বৃটেনের শত্রু বলতে চেয়েছে দলটি।
দেখা যাচ্ছে, ইউরোপের নেতৃত্বের আসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত দেখতে পেলেই ইইউ-এর সদস্য পদে নিজেদের অবস্থানে বৃটেনের আপত্তি থাকছে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে ইউরোপকে একসময় নেতৃত্ব দিয়েছিল বৃটেন।
২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা মোকাবিলার সময়েও সমগ্র ইউরোপের নেতৃত্বে থেকেছিল বৃটেন। ইউরোপের ওপরে বৃটেনকে তখন ক্ষুব্ধ দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button