ফিলিস্তিনিদের মানবেতর গুহাজীবন
দখলদার ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ বাধা প্রদান করার কারণে আল-খলিল (হেবরন) শহরের আশপাশে গুহাগুলোয় বসবাস করছে অবরুদ্ধ পশ্চিম তীরের অসংখ্য ফিলিস্তিনি পরিবার। অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্য তাদের বসতি এলাকাকে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। নিজেদের বসতি এলাকায় ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর নির্মাণ করতে বাধা দিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
শহরটির ফিলিস্তিনি বাসিন্দা নোমান হামামদা (৫৭) আনাদোলু সংবাদ সংস্থাকে জানান, তিনি ও তার সহযোগীরা এমন অবস্থার মাঝেও ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাড়ি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইসরাইলিরা অনুমতি ছাড়া বাড়ি নির্মাণ করার অভিযোগ এনে সেসব স্থাপনা গুঁড়িয়ে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। দখলদার ইহুদি কর্তৃপক্ষের এই এলাকায় ফিলিস্তিনিদের বাড়ি নির্মাণের অনুমতি ঘটনা বিরল।
হামামদা তার ১৩ সদস্যের পরিবার নিয়ে বর্তমানে ৩০ বর্গমিটারের একটি গুহায় বসবাস করছেন। সেখানে নেই কোনো মৌলিক সুযোগ-সুবিধা। তবু তার মতো সব ফিলিস্তিনিদের কাছে পৈতৃক ভূমি ইহুদিদের কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার চেয়ে গুহাজীবনই বেশি পছন্দ। তিনি বলেন, দখলদার বাহিনী আমাদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি এই ভূখণ্ড ত্যাগ করব না। এখানে জীবন যাপন খুবই কঠিন। তবুও এখানেই আমরা থাকতে চাই।
হামামদার বসবাসের গুহাটি তিন ভাগে বিভক্ত। একটি ঘুমানোর ঘর, একটিতে মালামাল রাখা ও তৃতীয়টি ব্যবহৃত হয় মেহমানদারির জন্য। গুহার বাইরে একটি কাঠের চুলায় তার স্ত্রী রাসমিয়া রুটি তৈরি ও অন্যান্য রান্নার কাজ করেন। রাসমিয়া বলেন, আমরা এখানে আদিম যুগের মতো বসবাস করছি। শুধু নিজেদের ভূমি রক্ষা করার জন্য আমরা এই জীবনকে মেনে নিয়েছি।
হামামদার পরিবারের মতো আরো প্রায় ১৫টি পরিবার আল খলিল এলাকার পাহাড়ি গ্রাম আল-মাফকারায় বসবাস করছে। ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে ইসরাইলের পাঁচটি সমৃদ্ধ ইহুদি বসতির জন্য সংরক্ষিত জায়গার মাঝে অবস্থিত একটি গুচ্ছগ্রাম আল মাফকারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইসরাইলি সৈন্যরা এখানে বারবার অনুপ্রবেশ করে ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়ি ধ্বংস করেছে। আল-মাফকারা গ্রামে ইসরাইলি বাহিনী সর্বশেষ অভিযান চালায় ২০১৩ সালে। সে সময় তাদের বুলডোজার এখানকার ঘরবাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী একমাত্র জেনারেটরটি গুঁড়িয়ে দেয়। একই অভিযানে ইসরাইলি সেনারা একটি স্থানীয় মসজিদও ভেঙে ফেলে।
হামামদার ১১ বছর বয়সী কনিষ্ঠ ছেলে আদম জানায়, ‘আমি আর টেলিভিশন দেখতে পারি না। কারণ ইসরাইলিরা আমাদের জেনারেটর ধ্বংস করে দিয়েছে।’ আদম ও তার বন্ধুরা প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে পাশের শহরের স্কুলে যায়। আদম জানায়, ‘স্কুল থেকে ফিরে আমি গবাদিপশুগুলো দেখাশোনা করি অথবা বন্ধুদের নিয়ে মাঠে খেলতে যাই। ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই আমাদের ধাওয়া করে, ধরতে পারলে পেটায়।’
মার্কিন মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত অসলো চুক্তি অনুসারে, সমগ্র পশ্চিম তীরের দুই-তৃতীয়াংশের সমান এই অসুখী গ্রামগুলো তথাকথিত ‘এরিয়া সি’ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলটি চুক্তি অনুসারে পূর্ণ ইসরাইলি নিরাপত্তা ও বেসামরিক নিয়ন্ত্রণভুক্ত। ১৯৯৩ ও ৯৫ সালে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পাদিত এ চুক্তিতে সমগ্র পশ্চিম তীরকে এ বি সি তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এরিয়া সি অঞ্চলটি ইসরাইলি প্রশাসনের আওতায় পড়েছে এই অজুহাতে ইহুদি বাহিনী এখানে ফিলিস্তিনিদের কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে দিচ্ছে না। আল-খলিল শহরের জনপ্রিয় প্রতিরোধ কমিটির সমন্বয়কারী রাতিব আল-জবুর আনাদোলু বার্তা সংস্থাকে বলেন, ‘আল-মাফকারা ও আশপাশের গ্রামগুলোয় অনেক ফিলিস্তিনি পরিবার পানি, বিদ্যুৎসহ অনেক মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই বসবাস করছে। এমনকি তারা যাতায়াতে বাহন হিসেবে গাধা বা ঘোড়া ব্যবহার করছেন।’ তিনি আরো বলেন, দখলদার বাহিনী বাসিন্দাদের উৎখাত করতে অনেকভাবে চেষ্টা করছে, যাতে তারা এখানে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করতে পারে।
আল-জবুরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, আল-খলিল এলাকার বেশির ভাগ ভূমি ইসরাইল কর্তৃক দখলের হুমকিতে রয়েছে। তারা এসব জমিতে আরো ইহুদি বসতি অথবা সামরিক প্রশিক্ষণ ঘাঁটি স্থাপন করতে চায়। তিনি বলেন, পাশের ইহুদি বসতির বাসিন্দারা নিয়মিতভাবে ফিলিস্তিনিদের নির্যাতন করে। তারা গ্রামের নারী ও শিশুদের আক্রমণ করে, গাছ কেটে ফেলে এবং পশুদের বিষ প্রয়োগ করে। দুই মাস আগে ‘পিস নাউ’ নামে বাম ধারার একটি ইসরাইলি এনজিও বলেছে যে, অধিকৃত পশ্চিম তীরে আরো ৪৫০টি নতুন বসতি ইউনিট নির্মাণ করতে টেন্ডার আহ্বান করেছে ইসরাইল সরকার।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেম ইসরাইলের জবর দখলকৃত এলাকা। তারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে এ অঞ্চলটি দখল করে। আন্তর্জাতিক আইনে এই নির্মিত সব ইহুদি বসতি অবৈধ।
ফিলিস্তিনি আলোচকেরা স্থগিত শান্তি আলোচনা আবার শুরু করার আগে ইসরাইলি বসতি নির্মাণ বন্ধ দাবি জানিয়েছিলেন। বর্তমানে কার্যত এ শান্তি আলোচনার মৃত্যু ঘটেছে।