ব্রিটেনে বংলাদেশী কমিউনিটি : অসামাজিক কর্মকান্ড প্রতিরোধে দায়িত্ব ও কর্তব্য
ভুমিকা
এন্টি-সোসিয়েল বিহেভিয়ার এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে অসামাজিক আচরণ বা কর্মকান্ড। এটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক টার্ম যার মাধ্যমে নানাবিধ সামাজিক অপতৎপরতাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সাধারণতঃ সমাজে বা কমিউিনিটিতে সকলের শান্তিপূর্ন সহবস্থান নিশ্চিত করতে যেসব নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন মেনে চলা দরকার সেগুলোর প্রতি অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা কিংবা বৃদ্ধাঙ্গলী প্রদর্শনকেই অসামাজিক কর্মকান্ড হিশেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। দ্য ক্রাইম এন্ড ডিসঅর্ডার এক্ট ১৯৯৪ এর মতে এন্টি সোসাল বিহেভিয়ার হচ্ছে “….. an anti-social manner, that is to say, in a manner that caused or was likely to cause harassment, alarm or distress to one or more persons.” অসামাজিক আচরণ বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। অনেক সময় সাধারণ দৃষ্টিকটু আচরণ থেকে শুরু করে মারাত্মক অপরাধও এন্টি-সোসিয়েল বিহেভিয়ারের আওতায় চলে আসতে পারে। উল্লেখযোগ্য অসামাজিক আচরণগুলো হলো: হুমকী প্রদানমুলক আচরণ, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ও এভিউজ, শারিরীক নির্যাতন ও নিপীড়ন, মাদকের অবৈধ ব্যবহার ও ডিলিং, হেইট বা ঘৃণা ছড়ানোমুলক অপরাধ, উচ্চস্বরে গান ও মিউজিক বাজানো, গৃহপালিত জন্ত-যথা বিড়াল ও কুকুরকে নিয়ন্ত্রনে না রাখা, ময়লা ও আবর্জনা যত্রতন্ত্র ফেলে দেয়া, ঘরবাড়ীকে অনৈতিক ও অবৈধ কাজে ব্যবহার করা, অন্যের ঘরের গেইট বা ওয়ালে লেখালেখি করা, প্রতিবেশীকে অতীষ্ট করা, গ্যাংদের নিয়ে রাস্তাঘাটে জটলা পাকানো, রাস্তায় জনসমক্ষে মাদক সেবন করা ইত্যাদি।
আমাদের কমিউনিটি
মাদকসেবন ও অসামাজিক আচরণ বাংলাদেশী কমিউনিটিতে আজ একটি প্রকট সমস্যা হিশেবে দেখা দিয়েছে। নিকট আতীতে আমাদের কমিউনিটিতে এই সমস্যা এতোটা প্রকট ছিলো না। অতীতে আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিকে শান্ত ও আইন মান্যকারী কমিউনিটি হিশেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু সেই সুনাম এখন আর নেই। যে বয়সে আমাদের ছেলে-মেয়েরা সুন্দর জীবন গড়ার জন্য প্রত্যয়ী হবে এবং ভালো ক্যারিয়ার গঠন করে নিজের কমিউনিটি তথা গোটা বৃটেনে নিজের দেশের মান উজ্জল করে তুলবে, সে সময় তারা মাদকসেবন এবং অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে শুধু নিজেদের জীবনই ধ্বংশ করছেনা বরং কমিউনিটির সুনাম ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। এটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।
টাওয়ার হ্যামলেটসে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস। অথচ এই টাওয়ার হ্যামলেটসে মাদক সেবন ও অসামাজিক কার্যকলাপ আশংকাজনকহারে বেড়ে চলছে। দ্যা ডকল্যান্ড এন্ড ইস্ট লন্ডন এডভার্টাইজারে ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, অসামাজিক কার্যকলাপ সংঘটিত হওয়ার দিক থেকে লন্ডনের বারাগুলোর মধ্যে টাওয়ার হ্যামলেটস দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২০১২ সালে গোটা লন্ডন সিটিতে প্রতি ১ হাজার জনে যেখানে ৪৩টি অসামাজিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সেখানে শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় প্রতি ১ হাজার জনে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮টি। ঐ বছর পুলিশ টাওয়ার হ্যামলেটসে ১৭ হাজার অসামাজিক আচরণ সংক্রান্ত অপরাধ রেকর্ড করে। সর্বাধিক বাঙালি অধ্যুষিত এই বারার অবস্থা এমতো হওয়ার কথা ছিলোনা !
অসামাজিক কার্যকলাপের কারণ
মাদক সেবন, ড্রাগাসক্তি ও অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার বহুবিদ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যে কারণগুলো উল্লেখযোগ্য তা হলো: ঘরবাড়িতে ওভারক্রাউডিং – অর্থাৎ পর্যাপ্ত বাসস্থান না থাকার কারণে ছোট ঘরে বহু সদস্য নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস, ড্রাগ সেবনকারী ও মাদকাসক্ত সহপাঠিদের সাথে চলাফেরা, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, পারিবারিক জীবনে পিতামাতার সাথে সম্পর্কে দুরত্ব সৃষ্টি, শিক্ষার অভাব, নির্দিস্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারার কস্ট, মাস্তানী বা গ্যাং ফাইটের শিকার ও প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা, বেকারত্ব ও জীবনে অনিশ্চয়তা, একাকিত্ব থেকে ডিপ্রেশন, স্বল্পকালীন আনন্দ উপভোগের প্রবণতা, পারিবারিক কলহ, ঘরে অবহেলার শিকার হওয়া, স্কুলে কাংখিত পারফর্মেন্স দেখাতে ব্যর্থতা, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে নিয়মশৃখংলা ভঙ্গ করে দুঃসাহসিক কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি, মাদক সেবনের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে না জানা, তিক্ত যৌন অভিজ্ঞতা সম্পর্কীত সমস্যা, বাজারে প্রাপ্ত অন্যান্য দ্রব্যের মতোই অবাধে মাদক প্রাপ্তি (উল্লেখ্য, নির্দিষ্ট পরিমাণ এলকোহল পান করতে বিলেতে আইনগত কোনো বাধা নেই), কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে দুরে থাকা, বাস্তবতা এড়িয়ে চলার চেষ্টা ও ইয়ুৎ ফ্যাসিলিটিজ ও রিসোর্সের অভাব।
প্রতিকারে করণীয়:
পিতা-মাতার ভুমিকা
মাদক সেবন, ড্রাগাসক্তি ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে ছেলে মেয়েদেরকে বাঁচাতে পিতামাতাকে কান্ডারির ভুমিকা পালন করতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পিতামাতা সন্তানদের ব্যাপারে খুবই উদাসীন থাকেন। ছেলে মেয়েরা কী করছে? কম্পিউটারে অনলাইনে কী নিয়ে ব্যস্ত? কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে চলাফেরা করছে – এসব ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণাই নেই। ছেলে মেয়ে যখন মাদকাসক্ত বা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে বিপথগামী হয়ে যায় তখন মা বাবার জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু তখন তো সব শেষ। জ্ঞান ফিরে এলেও তখন আর করার কিছুই থাকেনা। একটি গাছ চারা থাকাবস্থায় স্থানান্তর করে যেকোনো জায়গায় রোপন করা যায় এবং সেটিকে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে বাঁচানো সম্ভব হয়। কিন্তু চারাটি যখন গাছে রূপান্তরিত হয়ে যায় তখন সেটাকে আর স্থানান্তরিত করা যায় না। স্থানান্তরিত করলে মরে যাওয়াই হয় গাছের শেষ পরিণতি। তাই তখন সেটার একেবারে মুলে কেটে ফেলতে হয়। অনুরূপভাবে আমাদের কমিউনিটিতে ছোটবেলায় সন্তানদের ব্যাপারে অভিভাবকরা সম্পুর্ণ উদাসীন থাকেন। তাদেরকে সঠিকভাবে নৈতিক শিক্ষা দেননা এবং তত্ত্বাবধান করেন না। আর সন্তান বড় হওয়ার পর তখন আর পিতামাতার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। ফলে ছেলেমেয়েরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। পিতা-মাতার তখন নীরবে চোখের পানি ফেলা ও আক্ষেপ করা ছাড়া আর কোনো কিছু করার থাকে না। তাই ছেলে-মেয়েরা ছোট থাকতেই পিতা-মাতাকে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে কঠোর শাসন করতে হবে, আবার কখনো স্নেহ-মমতায় কাছে টেনে নিতে হবে। একটু বড় হলে তাদেরকে বুঝাতে হবে। বিভিন্ন নৈতিক বিষয়ে তাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও পরামর্শ দিতে হবে। দুরত্ব নয় বরং সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে পিতামাতাকে সন্তানের ভালো বন্ধু ও শুভাকাংখী হতে হবে।
কমিউনিটি নেতাদের ভুমিকা
পিতা-মাতা ছাড়াও এ বিষয় কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বৃটেনে অধিকাংশ কমিউনিটি নেতাকে নিজেদের আত্মপ্রচারণায় যেভাবে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়, তাদেরকে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ব্যাপারে তেমন কোনো চিন্তা-ভাবনা করতে দেখা যায়না। ভবিষ্যত প্রজন্ম চোখের সামনে ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে অথচ সে ব্যাপারে কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের যেনো কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। বৃটেনে বাংলাদেশী রাজনীতি নিয়ে তারা দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান। বাংলাদেশ থেকে নেতা-নেত্রী বেড়াতে এলে তাদের কোথায় রাখবেন? তাঁদের জন্য কী করবেন? সংবর্ধনা অনুষ্ঠান কীভাবে আয়োজন করলে তাদের মন পাওয়া যাবে – এ নিয়ে রাতের ঘুম হারাম। অথচ নিজের সন্তান, প্রতিবেশীর ছেলে-মেয়ে চোখের সামনে উচ্ছন্নে যাচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। অথচ ওদের রক্ষায় যদি যথাসময়ে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো তাহলে গোটা কমিউনিটি উপকৃত হতো। এতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সুন্দরভাবে গড়ে উঠার সুযোগ পেতো। সাথে সাথে বৃটেনেও আমাদের সুনাম ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেতো। তাই কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, নিতে হবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। নতুবা একদিন অবশ্যই আমাদের কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে ভবিষ্যত বংশধরদের কাছে জবাবদিহী করতে হবে।
ধর্মের ভুমিকা
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অভিভাবক ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ একেবারেই উদাসীন বলে মনে হয়। পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, মন্দ কাজ বর্জন করা, অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা, সত্য কথা বলা, উগ্রপন্থা পরিহার করা, হত্যা করা মহাপাপ, সৎ পথে চলা, সৎ ও ভালো কাজ করার পুরস্কার ও পরিণতি ইত্যাদি নৈতিক এবং মৌলিক কথাগুলো ধর্ম ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে! অথচ সন্তানদেরকে এই মৌলিক বিষয়গুলো জানানো ও বুঝানোর ক্ষেত্রে কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রাথমিকভাবে এই বিষয়গুলো শিখানোর দায়িত্ব কি পিতামাতার নয়? আমাদের সন্তানের প্রতি পিতামাতারা কি সে দায়িত্ব পালন করছেন? মনে রাখা উচিৎ, “Prevention is better than cure” অর্থাত “প্রতিরোধ হচ্ছে প্রতিকারের চেয়ে উত্তম”। সন্তানেরা মাদকাসক্ত হওয়ার পর ভালো করার ব্যর্থ উদ্যোগ নেয়ার পরিবর্তে মাদকাসক্ত যাতে না হয়, সে ব্যাপারে কার্যকরি ব্যবস্থা নিতে হবে। আপনি আপনার সন্তানকে সার্বক্ষণিক গাইড করতে পারবেন না। তার বন্ধু-বান্ধব আপনি নির্বাচন করে দিতে পারবেন না। স্কুল কলেজে কার সাথে চলে? ছুটির আগে বা পরে কোথায় যায় এবং কী করে ইত্যাদি বিষয়াদী স্বাভাবিক কারণে আপনি সবসময় খেয়াল রাখতে পারবেনা না। তাই সন্তানকে এমনভাবে গাইড করে গড়ে তোলা দরকার যাতে করে সে নিজে নিজেকেই গাইড করতে পারে। আর এটাই হবে সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা।
উপসংহার
পরিশেষে বলতে চাই, মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপ বাঙালি কমিনিটিতে একটি মারাত্মক সমস্যা হিশেবে চিত্রিত হয়ে আছে। এই সমস্যা নিয়ে সচেতন সকল অভিভাবক আজ দারুনভাবে উদ্বিগ্ন। তাই বৃটেনের প্রতিকুল পরিবেশে সন্তানদেরকে কীভাবে প্রকৃত মানুষ হিশেবে গড়ে তুলবেন সে চিন্তা ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যেক অভিভাবককে নিতে হবে। মাদক সেবন, ড্রাগাসক্ত ও অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হবার পর পানি পড়া কিংবা তাবিজ-কবজ দিয়ে মাদকমুক্তি সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সচেতন অভিভাবক ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে সঠিক পদেক্ষপ নিতে হবে। নতুবা বিলেতে বাঙ্গালী কমিউনিটির কপালে অনেক দুর্গতি রয়েছে ।
ব্যারিস্টার নাজির আহমদঃ ব্রিটেন প্রবাসী বিশিষ্ট আইনজীবি, লেখক ও বিশ্লেষক।
বি: দ্র: এটি লন্ডনে অনুষ্টিত ১৫’ই মার্চ ২০১৫ ইংরেজি তারিখে “লন্ডন সিটিজেনস ফাউন্ডেশন” আয়োজিত “Drug and ASB: Roles & Responsibilities of Community Leaders” শীর্ষক এক সেমিনারে ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ কর্তৃক উপস্তাপিত মূল প্রবন্ধ ।