উন্নয়নের বিলবোর্ডে কোটি টাকার ক্ষতি
রানা হানিফ : ‘উন্নয়নের অঙ্গীকার ধারাবাহিকতা দরকার’ এই শ্লোগানে রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে স্থাপিত বিলবোর্ড ‘দখল’ করেছে সরকারের উন্নয়ন বার্তা।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকার অনুমোদন ও অনুমতি না নিয়েই এসব বিলবোর্ডে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উন্নয়নের স্বচিত্র বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের বিলবোর্ডগুলোর চিত্র রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে হতভম্ব হয়ে পড়েছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও বিজ্ঞাপনদাতারা।
রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, মৎস্যভবন মোড়, পল্টন, গুলিস্থানসহ এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এসব বিলবোর্ড ‘দখল’ হয়নি। তবে সরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সরকারদলীয় নেতাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন চিত্র সম্বলিত বিলবোর্ডগুলো এই ‘দখলদারিত্ব’ থেকে মুক্ত রয়েছে।
তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এসব বিলবোর্ডে সরকার দলের দলীয় শ্লোগান ব্যবহার করা হলেও প্রচারক সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। ফলে অনেকেরই অজানা রয়েছে কার বা কোন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসব বিলবোর্ড করা হয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। তবে অনেকেই দিতে পারছে না প্রকৃত তথ্য। অন্যদিকে বিলবোর্ডগুলোর প্রকৃত মালিক ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন রয়েছে ‘জানা-অজানার’ দোলাচলে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি সূত্র এ ব্যাপারে জানায়, গত বৃহস্পতিবার এসব বিলবোর্ড সংক্রান্ত একটা চিঠি সিটি করপোরেশনের কর বিভাগকে দেওয়া হয়েছে।
তবে এমন তথ্যে সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান করকর্মকর্তা মোস্তাফা কামাল বলেন, সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কোনো চিঠি সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে এসব বিলবোর্ড ভাড়া বা ইজারা দিয়ে থাকি। তারা কোনো কোম্পানি বা কার বিজ্ঞাপন প্রচার করবে এটা সিটি করপোরেশনের দেখার বিষয় না। এ ব্যাপারে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোই ভালো বলতে পারবে।
তবে এসব বিলবোর্ডের দায়িত্বে থাকা একাধিক বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলতে রাজি হন। রাতারাতি এসব বিলবোর্ড কোনো প্রকার অনুমতি ও অনুমোদন ছাড়া দখল হওয়ায় প্রত্যেকটি সংস্থাই হতাশা প্রকাশ করেছে। তবে রাজনৈতিক ও সরকারদলীয় হওয়ায় বিষয়টি স্পর্শকাতর বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকেই। অধিকাংশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা নীরবে আর্থিক ক্ষতি মেনে নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে কথা বলা হলে দেশের অন্যতম একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে জানানো হয়, শুধুমাত্র শাহবাগ এলাকাতেই প্রতিষ্ঠানটির চারটি বিলবোর্ড দখল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সংস্থাটির সঙ্গে কোনো প্রকার যোগযোগ করা হয়নি।
সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বলেন, গতকাল (শনিবার) সকালে দেশের খ্যাতনামা ফ্যাশন ও বুটিক হাউজ থেকে আমাকে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়। ঈদ উপলক্ষে এই ফ্যাশন হাউজটির অনেকগুলো বিজ্ঞাপন আমরা মাস চুক্তিতে প্রচার করেছি। কিন্তু ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে এভাবে বিলবোর্ডগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় ফ্যাশন হাউজ কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার বিল (পাওনা অর্থ) না দেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র একটি ফ্যাশন হাউজ না, আরো অনেক ফ্যাশন হাউজ ঈদকে সামনে রেখে এসব বিলবোর্ড আমাদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপনের জন্য ভাড়া নিয়েছে। কিন্তু ঈদের আগের সপ্তাহে এভাবে বিলবোর্ডগুলো দখল হওয়ায় কেউ পাওনা টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের এই লোকসান মেনে নিতে হচ্ছে।
অপর আরেক বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে দেওয়া হলো ভিন্ন তথ্য। তারা জানায়, বিলবোর্ড দখলের এমন চিত্র এই প্রথম না। এর আগেও সরকার দলের অঙ্গ সংগঠন আওয়ামী যুব লীগ, কৃষক লীগ ও শ্রমিক লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে গত বছর এভাবে দখল করা হয় অনেক বিলবোর্ড। তবে এবার দখল হওয়া বিলবোর্ডে সংখ্যা অনেক বেশি।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করার সাহস আমাদের নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের এগুলো মেনে নিতে হচ্ছে। আমরা চাইলেও মামলা করতে পারব না। অনেকে প্রতিবাদ করতে গেলে তা আমাদের জন্য হুমকি হতে পারে। আমাদের ব্যবসা করে খেতে হয়। তাই এগুলো মেনে নেওয়াটাই ভালো।
দখল হওয়া বিজ্ঞাপন দাতাদের মধ্যে অধিকাংশ হলো ফ্যাশন বা বুটিক হাউজ ও ডেভেলপার কোম্পানি। তবে সরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি টেলিটকের থ্রী-জি’র বিজ্ঞাপন সম্বলিত বিলবোর্ড ও সরকারদলীয় বেশকিছু এমপি ও নেতাদের ডেভেলপার কোম্পানির বিজ্ঞাপন বিলবোর্ড মুক্ত রয়েছে এই দখল থেকে।
কোটি টাকার অধিক আর্থিক ক্ষতি : সরকারের উন্নয়নের চিত্র সম্বলিত বিলবোর্ডের জন্য কোটি টাকার অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানির।
এ ব্যাপারে বিজ্ঞাপনী সংস্থা মুক্তি আর্টের এক কর্মকর্তা বলেন, ঈদকে সামনে রেখে আমরা বেশ কয়েকটি ফ্যাশন হাউজের কাজ নিয়েছিলাম। প্রতিটি বিলবোর্ডের জন্য সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা মাসিক চুক্তিতে এসব বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করি আমরা। আমাদের কোম্পানিরই প্রায় ২০টি বিলবোর্ড দখল হয়েছে। সেই হিসাবে আমাদের লোকসানের পরিমাণটা বুঝতেই পারছেন কেমন হবে?
তিনি বলেন, একেকটি বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন ছাপাতে আমাদের খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। আবার সিটি করপোরেশনকে প্রতি বছর প্রতি বর্গফুট বিজ্ঞাপনের জন্য দিতে হয় দুইশ’ ২০ টাকা করে। বছরের অধিকাংশ সময় বিলবোর্ডগুলো খালি পড়ে থাকে। উৎসব বা ইভেন্টকেন্দ্রিক হওয়ায় ঈদ, পহেলা বৈশাখের মতো দিনকে কেন্দ্র করে আমরা ব্যবসা করি। কিন্তু ঠিক যখন ব্যবসা করব তখনই যদি বিলবোর্ড দখল হয়ে যায় তাহলে আমাদের আর কি করার আছে। এসব বিষয়ে আমাদের কিছুই বলার নেই। মুখ বুজে সব মেনে নিচ্ছি।
এ ব্যাপারে আজিজ সুপার মার্কেটে অবস্থিত একাধিক ফ্যাশন ও বুটিক হাউজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
কে-ক্রাফট, প্লাস পয়েন্ট, সাদা কালো, নকশী, দর্জি বাড়ি, দেশি দশসহ বেশ কয়েকটি ফ্যাশন হাউজের শো রুমের কর্মচারীরা বলেন, ঈদের সময়টায় এসব ফ্যাশন হাউজের মূল আয়টা হয়। আর এজন্য আমরা বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক টাকা ব্যয় করি কাক্সিক্ষত ক্রেতা আকর্ষণের জন্য। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞাপনের এসব বিলবোর্ড দখল হয়ে যাওয়ায় আমাদের বেশ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একদিকে যেমন বিজ্ঞাপন প্রচারের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি অন্যদিকে এসব বিলবোর্ডের জন্য বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোকে কিছু টাকা অগ্রিম পরিশোধও করতে হয়েছে।
প্রচারকের সন্ধান মিলছে না : সরকারের উন্নয়নের চিত্রে পুরো ঢাকা শহর সয়লাব হয়ে গেলেও এখন সন্ধান মিলছে না এসব বিজ্ঞাপনের প্রচারক কে? এ ব্যাপারে সরকার বা আওয়ামী লীগ থেকে কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বিষয়টি তাদের কাছে অজানা বলে জানান।