চীনের জিনজিয়াং আরেক ‘তিব্বত’
তিব্বতের অশান্ত অবস্থার খবর প্রায় বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় কিন্তু দেশটির ‘আরেক তিব্বত’ নামে অভিহিত অঞ্চলটির মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এসব গণমাধ্যমে তেমন একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না।
মধ্যএশিয়ার সীমান্তসংলগ্ন চীনের সুবিশাল পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে সম্প্রতি জাতিগত উত্তেজনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেখানে চীনের বিপুল সেনা উপস্থিতি চোখে পড়ে। বেইজিং দাবি করছে যে, অঞ্চলটিতে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবেলা করতে সেখানে এ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
জিনজিয়াংয়ের আয়তন ফ্রান্সের তিন গুণ। অঞ্চলটিকে বাণিজ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল।
কিংবদন্তির রেশম মহাসড়ক বরাবর অবস্থিত জিনজিয়াংয়ের মরুদ্যান শহরগুলো বহু শত বছর ধরে অতি প্রয়োজনীয় যাত্রাবিরতির স্থল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ ইতিহাসের সাথে বিজড়িত রয়েছে জিনজিয়াংয়ের এক অনন্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
জিনজিয়াংয়ের আদিবাসী হচ্ছেন উইঘুররা। তারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। উইঘুররা জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে তার্কিক। চীনের অন্য সব এলাকার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী হান জাতিগোষ্ঠী ও তার শাসকদের থেকে উইঘুররা সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারিভাবে চীনা সাম্রাজ্যের সাথে নানা টানাপড়েন ও উত্থান-পতনের পর বর্তমানে জিনজিয়াংকে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ হিসেবে। বেইজিং দাবি করে থাকে যে, জিনজিয়াং সব সময়ই চীনের অংশ ছিল। তবে ওই অঞ্চলের ইতিহাসে চীনের প্রাধান্য থাকলেও বেইজিংয়ের এ দাবির সাথে বাস্তবতার ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। মধ্যএশিয়া ও তুর্কিভাষাভাষী দেশগুলোর সাথে অঞ্চলটির একীভূত থাকার বিষয়টিকে চীন সবসময়ই উপেক্ষা করে আসছে। আজো জিনজিয়াংয়ের উইঘুর জনগণ সাংস্কৃতিকভাবে পূর্ব অঞ্চলের বেইজিংয়ের চীনাদের চেয়ে পশ্চিমের তুর্কিদেরকেই অধিকতর আপন বলে গণ্য করে। এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে হান চীনারা। তারা মনে করে জিনজিয়াংয়ের ওপর চীনা নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ বৈধ।
‘চীনা’ জিনজিয়াং
জিনজিয়াংয়ের ওপর চীনা নিয়ন্ত্রণ জিনজিয়াং : চাইনাস মুসলিম ফর নর্দওয়েস্ট গ্রন্থের লেখক মাইকেল ডিলন বলেছেন, ‘আমি চীনের বহু মানুষের সাথে অঞ্চলটি নিয়ে কথা বলেছি তাদের কেউই এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। তারা একে সবসময়ই জংগুয়ো জিনজিয়াং (চীনা জিংজিয়াং) বলে অভিহিত করে যেমনটি তিব্বতের ক্ষেত্রে তারা জংজুয়ো জিজাং (চীনের তিব্বত) বলে উল্লেখ করে। তারা এভাবে মনে করে যে এ অঞ্চল সবসময় চীনের অংশই ছিল।’
ডিলন বলেন, এ অঞ্চলের অত্যন্ত জটিল রাজনীতি, অর্থনীতি ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সম্মিলিত কারণেই হয়ত তারা অঞ্চলটির ওপর এত গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। তিনি আরো বলেন, জিনজিয়াং অঞ্চলটি বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামালসমৃদ্ধ এবং এর কৌশলগত অবস্থান রাশিয়ার থেকে চীনকে নিরাপদ করেছে। তবে তিনি আরো বলেন, এ ধারণাও প্রচলিত আছে যে, ‘চীন যদি জিনজিয়াংকে তার অন্তর্ভুক্ত না রাখতে পারে তাহলে সে মুখ দেখাতে পারবে না, কারণ জিনজিয়াং হচ্ছে মাতৃভূমির অংশ।’ যা এর শীর্ষে রয়েছে তা হলো, স্পষ্টত জিনজিয়াং হচ্ছে চীনের অহঙ্কার, দেশটির আর কোথাও এর কোনো তুলনা নেই।
চীনের এক ষষ্ঠাংশ আয়তনবিশিষ্ট জিনজিয়াং কেবল দেশটির তুলার শতকরা ৩০ ভাগ উৎপাদন করে তাই নয়, উপরন্তু ১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীনের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার স্থলও হলো জিনজিয়াং। চীনের সব পদক্ষেপকে উইঘুররা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে তা হলো, চীনের ঘনবসতিপূর্ণ পূর্বাঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক হান চীনাকে জিনজিয়াং এনে পুনর্বাসিত করা।
বসতিস্থাপনকারী চীনাদের সংখ্যা বাড়ছে
জিনজিয়াং বসতিস্থাপনকারী হান চীনাদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৫৩ সালে তাদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখেরও কম। আর এখন তাদের সংখ্যা ৭৫ লাখ, যা দিন দিন দ্রুত বাড়ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে জানা যায়, জিনজিয়াংয়ে মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ হচ্ছে বসতিস্থাপনকারী হান চীনারা। অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ। হানরা যে জীবনধারা অনুসরণ করছে তা এ অঞ্চলের আদিবাসী উইঘুরদের কাছে অপরিচিত।
জিনজিয়াংয়ের সীমান্ত শহর ইলির বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী উইঘুর তুরসুন্তাই বলেন, ‘সারাক্ষণই অধিক সংখ্যায় হানদের এখানে আমদানি করা হচ্ছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন এখানে তাদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। এ অঞ্চলটি আমাদেরই, আমাদের মাতৃভূমি।’
মরুদ্যান শহর উরুমকির ২২ বছর বয়সী তরুণী হিসলাত বলেন, হানরা জিনজিয়াংয়ের রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করছে, আমরা দিন দিন একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ছি। আগে কাজ বা চাকরি পাওয়া অত্যন্ত সহজ ছিল, এখন ওরা আমাদের কাজ দিতে চায় না, হানদের চায়। পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু আমাদের করার কিছু নেই।
ইউনিভার্সিটি অব কানসাসের লিঙ্গুইস্টিক অ্যানথ্রোপোলোজির সহকারী অধ্যাপক এরিন ডউযের বলেন, গত দশকে জিনজিয়াংয়ের পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে আমরা বিশেষ করে উইঘুর বুদ্ধিজীবী ও উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী উইঘুরদের দলে দলে দেশ ত্যাগ করতে দেখেছি। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, জিনজিয়াংয়ে চীনা প্রকল্প সঠিক না হলেও তা তারা অবশ্যই কার্যকর করবে।
তিনি বলেন, তবে জিনজিয়াংয়ের সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষই এ একটি বিষয় স্বীকার করে যে, কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে পদক্ষেপ নিয়ে তা ভালো। এতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। ডউযের আরো বলেন, হানরাই নীতিনির্ধারণ করে এবং জিনজিয়াংকে চীনের নিয়ন্ত্রণে নিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হ্েচ্ছ। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর আচরণ করছে এবং উইঘুর ভাষার পরিবর্তে স্কুলগুলোতে চীনের ম্যান্ডারিন ভাষা চালু করা হয়েছে। এর পেছনে খোঁড়া যুক্তি দেয়া হচ্ছে, ভাষাগত কারণে উইঘুররা শিক্ষা ক্ষেত্রে চীনা মানার্জন করতে পারছে না। তবে উইঘুররা চীনা আত্মীকরণের বিরোধী এবং এ ব্যাপারে তারা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না।
ডউযের বলেন, উইঘুররা চীনাদের এসব পদক্ষেপে অত্যন্ত হতাশ ও ুব্ধ। তারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় হারানোর আশঙ্কা করছেন। এ কারণে উইঘুর তরুণেরা তাদের ধর্মের দিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় ঝুঁকছেন এবং আরবি ভাষা শিখতে মনোযোগী হচ্ছেন। তাদের কারো কারো সাথে কট্টরপন্থী গ্রুপগুলোর সংযোগ রয়েছে বলে চীনা কর্মকর্তারা দাবি করছেন। তবে একে চীনাদের থেকে উইঘুরদের পৃথক নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিচিতি বলে মনে করছেন ডউযের। উরুমকির হিসলাত বলেন, হানদের সাথে তাদের ভিন্নতার মূল হচ্ছে ধর্ম। আমরা হানদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতি। তিনি বলেন, ওদের কোনো ধর্ম নেই। তারা যা ইচ্ছা তাই খেতে পারে। ওরা ধর্মকর্ম করে না, কিভাবে তা করতে হয় তাও জানে না। তারা বিশ্বাসীও নন। হিসলাত বলেন, তারা উইঘুর ও মুসলমান। তিনি ও তার সঙ্গীদের কট্টরপন্থী হওয়ার কোনো ভয় নেই।