শার্লি এবদু যে সত্যকে অবজ্ঞা করে
মোজাফফর হোসেন: সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের দেশ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন শার্লি এবদুতে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর ওপর একটি বিকৃত কার্টুন প্রকাশিত হওয়ায় ইউরোপসহ সারা মুসলিম বিশ্বের মুসলমানেরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। জানুয়ারি মাসে এই পত্রিকা অফিসে হামলা হলে পত্রিকাটি তার পরবর্তী সংখ্যার প্রথম পাতায় আবারো মুহাম্মাদ সা:-এর ওপর ভিন্ন আর একটি কার্টুন প্রকাশ করে। দ্বিতীয়বার প্রকাশের পরও প্রতিবাদ করা হয় তামাম বিশ্বে। একই পত্রিকা কার্টুনটি দ্বিতীয়বার প্রকাশ করায় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই পত্রিকাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ কার্টুনগুলো প্রকাশ করেছে।
আর সে উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা বিশ্বের কাছে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করা। শার্লি এবদুই যে সর্বপ্রথম হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে এভাবে অবজ্ঞা করেছে এমনটি নয়, এ রকম অবজ্ঞা ইতোপূর্বেও বহুবার করা হয়েছে। খবরের কাগজের তথ্যমতে, ডেনমার্কের ‘জিলান্দ পোস্টেন’ পত্রিকাও হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে নিয়ে অনেক কার্টুন ছেপেছে। এই পত্রিকাটি ২০০৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মুহাম্মাদ সা:-এর ওপর ১২টি কার্টুন প্রকাশ করে। ২০০৬ সালে এসব কার্টুন আবার ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্দেশ্যে নরওয়ের একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশ করা হয়। এভাবে ইসলাম, মুসলিম ও মুহাম্মাদ সা:-কে নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার হয়ে আসছে পৃথিবীর অনেক দেশে ও জনপদে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত সালমান রুশদি কর্তৃক রচিত ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এবং খালিদ তুরানের ‘ইসলাম টু জিউস’। এই প্রকাশনাগুলোও ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: ও মুসলমানদের অবজ্ঞা করেছে বিস্তর।
ইসলামে পরপুরুষের সামনে নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমোদন নেই। অথচ সুন্দরী প্রতিযোগিতার অনুমোদন চেয়ে ড্যানিয়েলর মন্তব্য বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজে নিন্দা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ২০০৪ সালে প্রদর্শিত হয়েছে ডাচ পরিচালক ‘থিউড্যান গরার’ পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র, যেখানে দেখানো হয়েছে ধর্ষণ একটি ইসলামি বিধান। সুইডেনের জাদুঘরের জন্য ২০০৫ সালে অঙ্কন করা হয় একটি নগ্ন চিত্রকর্ম- যা কুরআনের আয়াতে আবৃত করে রাখা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য ৯০ শতাংশ মুসলমানের আবাসস্থল বাংলাদেশেও এসবের ধারাবাহিকতাকে অগ্রাহ্য করা হয়নি। এসব অপকর্ম অবলীলায় বাংলাদেশ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে সগৌরবে। ২০০৭ সালে ১৭ সেপ্টেমবর বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলো তার সাপ্তাহিক প্রকাশনা ‘আলপিন’ হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে বিদ্রুপ করে ‘নাম’ শিরোনামে একটি কার্টুন প্রকাশ করে। এর প্রতিবাদে ওই দিন বিকেলে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ‘প্রথম আলো’র কপিতে আগুন লাগিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ১৮ সেপ্টম্বর ২০০৭ তারিখে বাংলাদেশের আলেম সমাজ ‘প্রথম আলো’র এই প্রকাশনা বন্ধ করার দাবি করে এবং কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের আহ্বান জানায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বিশ্বব্যক্তিত্বদের অবদানের তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। এসব আলোচনার তথ্যমতে, মুহ্ম্মাাদ সা:-কে ঘিরে যেসব অপপ্রচার তা নিছক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইতিহাসের পাতায় হত্যা, খুন, নির্যাতন, জুলুম, অত্যাচারের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট সেই কুখ্যাত শক্তিধর উইলিয়াম জর্জ বুশ, বিসমার্ক, হালাকু, চেঙ্গিস খান, স্ট্যালিন, মুসোলিনি কিংবা হিটলারের সাথে মুহাম্মাদ সা:-এর তুলনা চলে না। মুহাম্মাদ সা: ছিলেন বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার অগ্রদূত। ধর্ম, ধর্মজাযক, ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মপ্রচারকদের সাথে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যভিত্তিক পর্যালোচনা করলে বেরিয়ে আসবে ভারতীয় পুরাণে দেবতা কর্তৃক সত্যবতী ধর্ষণের উপাখ্যান; দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গমর্ত্যজুড়ে ধর্ষণ করে বেড়াত, তার ইতিহাস। বেরিয়ে আসবে গ্রিকপুরাণে দেবরাজ জিউস ছিল প্রধান ধর্ষণকারী। আবার রামায়ণ-মহাভারতে সীতাকে চুরি করেছে দেবতারা। হজরত মুহাম্মাদ সা: এদের মতো কোনো ধর্মীয় লেবাসধারী ব্যক্তি নন। তিনি মানবতাপরিপন্থী এমন কোনো অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতা করেননি যে তাঁকে অবজ্ঞা, ঘৃণা, গ্লানি সহ্য করতে হবে। মুহাম্মাদ সা: ছিলেন সর্বজনপ্রশংসিত সফল সমাজসংস্কারক, নির্মল ধর্মপ্রচারক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, সুসম অর্থব্যবস্থার সুনিপুণ কারিগর এবং চরমভাবে মানবাধিকার সংরক্ষণের অন্যতম প্রবর্তক। তিনি যে আদর্শ-নীতি-নৈতিকতার প্রবর্তন করেছিলেন তাতে হতাশাগ্রস্ত ও অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব সমাজ পেয়েছিল আশার আলো। তিনি যে আরবদের নৈরাজ্যকর ও বিশৃঙ্খল সমাজকাঠামোর পরিবর্তে শান্তি ও সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেই সমাজব্যবস্থা ইতিহাসে হয়েছে সমাদৃত। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার, বানোয়াট কল্পকাহিনী, ধোঁকা ও প্রতারণাকে সঙ্গী করে হিংসা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে কেউ অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করার সাহস পেয়েছে, এমন নজির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। চরম বিশৃঙ্খল আরব সমাজের বেড়াজাল ভেদ করে তিনি ‘আল আমিন’ উপাধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘হিলফুল ফুজুল, মদিনার সনদ, হুদায়বিয়ার সন্ধি এবং হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের মতো বিরোধপূর্ণ সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করে পৃথিবীতে যে শান্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বদরের যুদ্ধে আটক যুদ্ধবন্দীদের সাথে তিনি যে আচরণ করেছিলেন সেটাও আধুনিক সভ্যতায় মানবাধিকারের অকাট্য দলিল হয়ে রয়েছে। মুহাম্মাদ সা: সেই যুদ্ধবন্দীদেরকে যে মানবাধিকার দিয়েছিলেন সেই মানবাধিকারের চেয়ে উন্নত মানবাধিকারের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর তাবৎ মোড়লেরা এখন পর্যন্ত স্থাপন করতে পারেননি। মক্কা বিজয়ের পর মক্কার সব অধিবাসীদেরকে তিনি সিক্ত করেছিলেন ক্ষমা, উদারতা, ভালোবাসা আর মহানুভবতার বৃষ্টিতে। অবজ্ঞা তো এই মহামানব হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর পাওয়ার কথা নয়? উল্লিখিত মিডিয়ার ধৃষ্টতা যে মানুষটিকে নিয়ে সেই মানুষটির ব্যাপারে বিশ্বসৃষ্টিকর্তা তার পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করছেন, নিশ্চয় মুহাম্মাদ সা:-কে শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী করা হয়েছে। আল্লাহ আবার বলেছেন,‘হে মুহাম্মাদ, আমি তোমাকে বিশ্বের রহমত বানিয়েছি’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-‘প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবন এক সর্বোত্তম নমুনা; এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি আশাবাদী এবং খুব বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে’ (সূরা আহযাব:২১)। গোটা কুরআন শরিফই হচ্ছে মুহাম্মাদ সা:-এর ব্যক্তিত্ব। হজরত আয়েশা রা: বলেন, ‘কুরআন শরিফের জীবন্ত রূপ মুহাম্মাদ সা:।’ এমন কঠিন চারিত্রিক নিশ্চয়তা যে মানুষ সম্পর্কে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন কি না, ভাবার অবকাশ আছে।
তিনি সেই মুহাম্মাদ সা: যাঁর কাছে পৃথিবীর সব মজলুমদের ন্যায়বিচার আছে; এতিমদের অবারিত সান্তনা আছে; বঞ্চিতদের অধিকার আছে; গরিব ও নিরাশ্রয় মানুষের আশ্রয় আছে; দুঃখী, পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য প্রেরণা আছে; সহায়-সম্বলহীন মানুষদের জন্য কর্মের উৎস আছে; কর্মবিমুখ হতাশাগ্রস্ত মানুষদের জন্য রয়েছে আশার প্রদীপ। এই চরম সত্যাশ্রয়ী মানুষকে বিকৃত করে এবং ইতিহাসকে অস্বীকার করে শান্তি ও মুক্তির পথ আশা করা যায় না।
হজরত মুহাম্মাদ সা: এমন ব্যক্তি নন যে, তাঁর কাছে কেউ বিচার চাইতে গিয়ে ন্যায়বিচার না পেয়ে ফিরে এসেছেন। ক্ষমা চাইতে গিয়ে কেউ ক্ষমা পাননি; বরং তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে আরবের ধনাঢ্য মহিলা বিবি খাদিজা তার সব সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্যের দায়দায়িত্ব মুহাম্মাদ সা:-কে দিয়েছিলেন। গোটা তায়েফবাসী মুহাম্মাদ সা:-কে মেরে শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েছিল; সেই নিষ্ঠুর-নির্মম চিত্তের তায়েফবাসীকে তিনি উদার মনে ক্ষমা করেছিলেন। ধনী-দরিদ্র ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন সাম্য-মৈত্রীর মেলবন্ধন। সুতরাং তাঁকে বিকৃত করার অর্থ দাঁড়ায় পৃথিরীর মানবতাকে বিকৃত করা। অতএব, মানবতার কাণ্ডারি এই মহামানব মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে অবিকৃত অবস্থায় অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন স্বমহিমায়।
লেখক : গবেষক