‘আরব নিউজ’ পত্রিকার একটি বিশ্লেষণ : অনিশ্চিত যাত্রায় মিসরের রাজনীতি

Egyptগণতন্ত্রসম্মত পন্থায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত মিসরের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুতির পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের প্রতিবাদে ও প্রেসিডেন্ট পদে মুরসির পুনর্বহালের দাবিতে মুসলিম ব্রাদারহুডের মিসরজুড়ে শুরু ক্ষুব্ধ আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র হস্তক্ষেপে ৬শ জনের মতো ব্রাদারহুড সদস্য-সমর্থক নিহত হওয়ার সরকারিভাবে খবর পরিবেশিত হলেও কয়েক হাজার লোক সেনা অভিযানে নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন স্বতন্ত্র সূত্রে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী ব্রাদারহুডের আন্দোলন সেনাবাহিনীর হত্যা অভিযানে পরাস্ত হয়নি বরং অশান্তি ও অরাজকতায় আক্রান্ত হয়েছে মিসর নামের পুরো দেশটি। অভিন্ন অবস্থা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৯৯০ দশকে আলজেরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট দেশটির নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পরবর্তীতে।
২০০৭ সালে সংসদীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হামাসকেও অনুরূপ বৈরী ভাগ্যবরণ করতে বাধ্য ক রা হয়েছিল।
সামরিক অভ্যুত্থানে ব্রাদারহুড সমর্থিত মুরসি সরকারের পতনপরবর্তী মিসর প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষকরা পরিস্থিতির সাংঘর্ষিক গতিবিধি দৃষ্টে রীতিমতো দুর্ভাবনায় পড়েছেন। মধ্যপ্রা্েযর রাজনৈতিক পটভূমি ও পরিবেশ গণতন্ত্র চর্চার জন্য আজো পর্যন্ত কি প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেনি এমন বিব্রতকর প্রশ্নে অনেকের মনে জন্ম নিতে শুরু করেছে। দেশগুলোর সমাজকাঠামোর বিশেষ গঠনবিন্যাসের পক্ষে গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে চলা সম্ভব নয় এমন অভিমতও অনেক পর্যবেক্ষকের মনে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু এছড়াও অন্য এক দল ভাষ্যকার যারা বলতে চান, সাম্প্রতিক অতীতে ও নিকট বর্তমানে নির্বাচনে বিজয়ী কয়েকটি দেশের দল ও সরকারের জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনার আলোকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সম্বন্ধে ঢালাও কোনো নেতিবাচক মন্তব্য নিক্ষেপের আগে যেকোনো পর্যবেক্ষককে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির আরো গভীর অধ্যয়নে প্রবেশ করতে হবে। তারা বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের বিভিন্ন  বিভাগে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সহনীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠা যেকোনো দেশে গণতন্ত্র চর্চার জন্য একটি অতি আবশ্যকীয় শর্ত। গণতান্ত্রিক প্রশাসন পরিচালনা কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না যদি প্রশাসনের একটি বিভাগ অন্য বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব কায়েমে তৎপর হয়ে ওঠে। বিভাগ বিশেষের এই কর্তৃত্ববাদী তার কারণে প্রশাসনে সমন্বয় ও ঐকমত্য বিদায় নিতে বাধ্য হয়।গণতন্ত্রের শিকড় সমাজ মানসিকতার গভীরে প্রবেশের সুযোগ এমন পরিস্থিতিতে পেতে পারে না।
গণতান্ত্রিক বহুপাক্ষিকতা বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতাসীন দলবিশেষ একতরফাভাবে দলীয় মতবাদ ও কর্মসূচি সব পক্ষের ওপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হলে মতবিরোধ ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। একদল পর্যবেক্ষক বলছেন, মিসরে তা-ই ঘটেছে। দলীয় কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় জনজীবনে প্রয়োগে ও বাস্তবায়নে মুরসি সরকার দেশে দীর্ঘকাল পোষিত সমাজ-মানসিকতায় যে আঘাত ও উদ্বেগ পৌঁছে দিয়েছে-দেখা গেছে, সাধারণ জনসমাজ সেটিকে অমান্য ও প্রতিরোধ করার মধ্য দিয়ে মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। শেষ এখানেই হয়নি। সেনাবাহিনীও মুরসি সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সবাই শঙ্কিত হয়েছে মিসরের দীর্ঘদিনের জীবনযাত্রা প্রণালী মুরসি সরকারের হাতে পড়ে অপরিচিত এক পথে বুঝিবা যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে।
উল্লেখিত হতে হয়, ১৯৫২ সালের পর থেকে বহু উত্থান-পতন মিসরের রাষ্ট্রীয় জীবনে ঘটে গেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মিসর কথিত হতে থাকলেও দেশটির প্রকৃত ক্ষমতা সব সময় অর্পিত থেকেছে সেনাবাহিনীর ওপর। বলা হয় ঐ সময়গুলোয় সেনা কর্তৃত্ব বহাল থাকা সত্ত্বেও একটি বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত দেশের জনগণ স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে। হোসনি মোবারক ব্রাদারহুডের কর্মকা- কোনো সময়েই নিরঙ্কুশ হতে দেননি। যদিও আইন পরিষদে ব্রাদারহুডের উপস্থিতি সীমিত মাত্রায় ও সংখ্যায় তিনি বরদাশত করে এসেছে এবং যাদের উগ্রপন্থী মনে করেছেন তাদের জেলে পাঠিয়েছেন। মোবারক তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। কেন ব্যর্থ হলেন সে আলোচনা অন্যত্র হতে পারে।
মোবারক বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারে ২০১২ সালের নির্বাচনে জনগণের পছন্দের দল হিসেবে আবির্ভূত হয় মুসলিম ব্রাদারহুড।
কেউ কেউ বলেন, বহু বছরজুড়ে ক্ষমতাসীনদের নির্মম অত্যাচারে ও নিষ্পেষনে জর্জরিত হওয়ার ক্ষতবিক্ষত স্মৃতির তাড়নাতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই ব্রাদারহুড দলীয় আদর্শের তড়িঘড়ি বাস্তবায়নে এগোতে গিয়ে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বৃহদংশের সমর্থন-সহানুভূতি দ্রুত হারাতে শুরু করে। ব্রাদারহুড সমর্থিত সরকারের ওপর বিশেষভাবে বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠে মিসরের সেনাবাহিনী। যদিও বিশেষভাবে লক্ষণীয় পাশ্চাত্য ও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক সংস্কারে রীতিমতো বাস্তবসম্মত ও সফল পদক্ষেপে অগ্রসর হয় মুসলিম ব্রাদারহুড। মোবারক যমানার তুলনায় মুরসি শাসনামলে দু’দেশের গোয়েন্দা যোগাযোগ ও কর্মকান্ডে চমৎকার উন্নয়ন সাধিত হওয়ার কথা খোদ ইসরাইলকেও স্বীকার করতে শোনা যায়।
একথা সত্য যে, মিসরীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপমূলক ভূমিকা মুরসি খর্ব করতে চেয়েছিলেন। বলা হয় কুয়েত, জর্দান, গাজা, আরব আমিরাত ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে ব্রাদারহুডের (ইখওয়ান) কর্মতৎপরতা চাঙ্গা করে তুলতেও মুরসি সরকার নাকি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তিউনিসিয়ার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠতে শুরু করে যে, মিসরে ব্রাদারহুড ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে আন নাহদার রাজনীতিতে মারমুখি প্রবণতা ক্রমে প্রবল হতে শুরু করেছে। কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতা তিউনিসিয়ায় নিহত হন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button