নিজেদের ভালো-মন্দের উপলব্ধি মুসলিম বিশ্বে ঘটবে আর কবে ?
যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে মধ্যপ্রাচ্য আবার। একই সময়ে যুদ্ধ চলছে মধ্যপ্রাচ্যের চারটি ক্ষেত্রে। অঞ্চলের ইতিহাসে এটি প্রথম ঘটনা। ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার পর যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে ইয়েমেন। লঘু মাত্রায় যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছে সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, মিসর, সুদান ও লেবানন।
একভাবে ও অন্যভাবে এরাও মধ্যপ্রাচ্যের অংশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের শরিক বলা হয় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে। এরাও জড়িত দ্বন্দ্ব বিরোধ সংঘাতে। কেন এমন হলো- প্রশ্ন অনেকের। কে লাভবান হচ্ছে প্রায় সারা মুসলিম বিশ্বব্যাপী এই যুদ্ধ সংঘাতে? ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িছে মুখ্যত আলি আব্দুল্লাহ সাফেহর মতো উদ্ধৃত স্বার্থসর্বস্ব ও ক্ষমতালোভী নেতৃত্বের কারণে স্পষ্ট বোঝা যায়।
কিন্তু বাকি এলাকাগুলোয় যুদ্ধের আগুন জালিয়ে রাখা হচ্ছে কার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য? ৩৩ বছর নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছতন্ত্র চালিয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হন আব্দুল্লাহ সালেহ গণআন্দোলনে। দেশটিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জিসিসি ও জাতিসংঘের উদ্যোগ অবশ্যকীয় হয়ে দেখা দেয়। সালেহর বিদায়ের পর ইয়েমেনবাসী দেশে সুদিনের শুভাগমন প্রত্যাশা করেন। মনে রাখতে হয়, কয়েক হাজার বছরের অতীত সভ্যতার গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে দেশটির। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুতির পরও ক্ষমতালাভের জন্য ষড়যন্ত্র রচনায় প্রকৃত্ত হতে দেখা যায় সালেহকে। যুদ্ধে বিবাদে দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও তার ক্ষমতা চাই। গৃহযুদ্ধে ৩ লাখ সিরিয়ানের জীবনাবসান ঘটার পরও ক্ষমতায় বহার থাকতে চান বাশার আল আসাদ যেমন, তেমনটি ইয়েমেনে চান ক্ষমতাচ্যুত সালেহও। সালেহর ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসাবে ইরানের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ইয়েমেনী যুদ্ধে একপর্যায়ে সানা দখলে নিয়ে নেয় শিয়াহুতি বিদ্রোহীরা। ক্ষমতা থেকে তারা বিতাড়িত করে প্রেসিডেন্ট হাদিকে। ইয়েমেনে ইরানীদের প্রভাব বিস্তৃতিতে বিচলিত না হয়ে পারে না আরববিশ্ব। ইয়েমেনে বিমান হামলা চালাতে উদ্যত হয় সৌদি আরব। প্রতিবেশী কোনো আরব দেশে সৌদি আরবের এই বিমান হামলা সারা আরবের ইতিহাসে এটিই প্রথম।
আরব দেশগুলোর উদ্বেগ আগে থেকেই সহ্যের সর্বশেষ সীমান্তে এসে উপস্থিত থেকেছে ইরাক, সিরিয়া ও অঞ্চলের অন্যান্য ক্ষেত্রে ইরানের উপস্থিতি ও অন্তর্গ্রস্ততায়। এক কথায় সৌদি আরবের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে ইরান তার আরব বিশ্ববিরোধী তৎপরতা নিয়ে। নিশ্চেষ্ট বলে বসে এই দৃশ্য উপভোগ সৌদি আরবের পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। বহু শতকের সম্পর্ক রয়েছে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের মধ্যে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও এর ফলে পুরো অঞ্চলে সৃষ্ট ও ভূ-রাজনীতির পরিবর্তিত সমীকরণ আরব দেশগুলোর কূটনীতিতে আগে থেকেই অস্থিরতা সঞ্চারিত করেছে। তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার সম্পর্কের নতুন বিন্যাস চেষ্টাও সৌদি আরব তথা আবর বিশ্বের জন্য স্বস্তির কোনো কারণ হয়ে দেখা দেয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধ সহিংসতার শিয়া-সুন্নি বিরোধকে কারণ হিসেবে দর্শানোর চেষ্টা অর্বাচীনের অতিস্মরণীয়করণ চেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। পর্যবেক্ষকরা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধ সহিংসতার কারণ খুঁজতে হবে অন্যত্র- শুধু সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মধ্যে নয়। সম্ভবত এই উপলব্ধিতে তাড়িত হয়েই শার্ম আল শেখ বৈঠকে শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে ইয়েমেন যুদ্ধে সমাপ্তি চেয়েছে আরব লীগ। এই আহ্বান কেউ ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম পন্থা মনে করেন পর্যবেক্ষকরাও। তাদের মতে, আরব বিশ্বে অন্তর্কলহ সঞ্চারের অপচেষ্টায় ইরান কোনোভাবে লাভবান হতে পারবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে বিবাদে জড়িত স্থানীয় সব পক্ষকে মনে রাখতে হবে, অঞ্চলের চলতি দুরবস্থা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অতীত ঔপনিবেশিক প্রভুদের সৃষ্ট দুষ্ট ক্ষতের ধারাবাহিকতা। এই ক্ষত তারা সৃষ্টি করেছে ‘পিকট-সাইকস’ নামে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্য মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে অস্বাভাবিক সীমান্তভিত্তিক বিভিন্ন রাষ্ট্রবিন্যাসের মাধ্যমে। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন শুরু হয় পশ্চিমা প্রভুদের ঐ ষড়যন্ত্রেরই জেরে। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষকেরা মুসলিম দেশগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান। নিজেদের লাগাতার দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার জন্য মুসলমানরাও কম দায়ী নন। দুশমনদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসার। আন্তরিক চেষ্টা করতে মুসলিমদের খুব কমই দেখা গেছে।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ওপর হামলা মাত্রই ছিল না- ছিল পুরো উম্মার বিরুদ্ধে আগ্রাসন। হামলার মধ্য দিয়ে ইসলামী বিশ্বে সাম্প্রদায়িক বিরোধ বিদ্বেষ এমন তীব্রভাবে উসকে দেয়া হয় যে একপর্যায়ে যার ফলশ্রতিতে সেখানে আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় আইএসয়ের।
ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান ও অন্যত্র আজ মুসলিমদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিবাদে যে রক্তক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পেছনে ১৪শ’ বছরের মুসলিম ইতিহাসে তার তুলনা মেলে না। আজকের মতো অন্তর্বিবাদে বিভক্ত পরস্পরনিদ্বিষ্ট মুসলিমবিশ্ব অতীতে আর কখনো ছিল না। মুসলিম দেশগুলোকে আরো খন্ডবিখন্ড ও পরস্পরবিদ্বিষ্ট করে তুলতে উদ্যত মার্কিন নব্য সংরক্ষণবাদীদের এই চক্রান্ত সম্বোন্ধে অবহিত ও একে রুখতে তৎপর হতে না পারা হবে মুসলমানদের জন্য সত্যিই একটি খুব বড়ো দুর্ভাগ্য।