হিথ্রোয় লাঞ্ছিত ব্রিটিশ তরুণীর বিবরণ
‘ব্রিটেনে মুসলমানদের সাথে বৈষম্যের কথা বিশ্বাস করতাম না’ ব্রিটেনের মুসলমানদের যেসব অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হতে হয় আমি সে ব্যাপারে বরাবরই সচেতন ছিলাম। তবে অনেক সময় ‘মুসলমানরা ভিকটিম’ এই ধরনের বিবরণ সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ পোষণ করতাম। বলছিলেন হিথ্রো বিমান বন্দরে লাঞ্ছিত ফরাসি ভাষার শিক্ষার্থী ২২ বছর বয়সী তরুণী হান্না ইউসুফ।
ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, আপনি একা বাইরে গেল সেটি কেন বড় ঘটনা হবে? বিশেষ করে, আপনার পোশাক বা চেহারার কারণে। আপনার মনের ভেতর যদি গোপন করার কিছু না-ই থাকে তাহলে সমস্যা হবে কেন? শুধু সহায়তা করুন। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তল্লাশির জন্য সবাইকে আটকাবেন কেন? তারা তো শুধু যথাযথা কারণসহ সন্দেহজনক অপরাধীদের আটকাবেন ও তল্লাশি করে থাকেন।
কিন্তু আমার এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। মাত্র এক মাস আগে যখন আমি দুবাই থেকে আসার পথে লন্ডনে হিথ্রো বিমান বন্দরে অবতরণ করি। হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে এক পাশে সরিয়ে নেয়া হলো এবং পাসপোর্ট হাতে নিতে বলা হলো। এক নারী কর্মকর্তা আমার মাথার স্কার্ফ থেকে জুতা পর্যন্ত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। আমি সৌজন্যমূলক মৃদু হাসি দিলাম; কিন্তু তিনি ছিলেন গম্ভীর। ভ্রমণবিষয়ক তথ্য জানতে চাইবেন এমনটা প্রত্যাশা করে আমি তাকে আমার পাসপোর্ট দিলাম। কিন্তু তিনি আমার দিকে এমনভাবে চাইলেন যাতে আমার মনে হচ্ছিল, তার দৃষ্টিতে ঘৃণা ঝরছে।
তিনি আমাকে সাধারণ প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, যেমনÑ আপনি একা কেন? আমি তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যথাযথ উত্তর দিতে লাগলাম। তিনি তখন আমার সব কথাকেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন। তার এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে, আমি নিজেই আমার টিকিটের মূল্য পরিশোধ করেছি এবং আমার তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছে কিভাবে একজন মুসলিম তরুণী একাকী মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণে যেতে পারেন।
তিনি আমাকে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন যা আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলল। সম্ভবত আমার চলে যাওয়ার পথ আটকাতেই তিনি এটি করলেন। ভয়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। আমার চোখের পানি অগ্রাহ্য করে তিনি আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই একজন অপরাধীর সাথে যে ধরনের আচরণ করা হয় আমার সাথে সে ধরনের আচরণ করতে শুরু করলেন। অনেক সময় কেটে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে শুরু করলেন যে, পুরুষ জঙ্গিদের প্রলোভন ছাড়াই একজন অবিবাহিত মুসলিম তরুণীর পক্ষে একা ভ্রমণ করা সম্ভব।
আমি এই ঘটনায় প্রচণ্ড আহত হই। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের যেকোনো প্রশ্নের জবাব দিতে আমার সমস্যা ছিল না। কিন্তু এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। নির্দোষ কাউকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ ছিল। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে আমি কোনো জঙ্গি নই, তারপরও তিনি আমাকে সন্দেহ করে সে ধরনের আচরণ করতে থাকলেন।
ব্রিটেনের অন্যান্য বর্ণবৈষম্যের ঘটনার সাথে তুলনা করলে এটা ছোট ঘটনা মনে হতে পারে। কিন্তু এই ছোট ঘটনার প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলছে এবং এর ফলে ব্রিটিশ মুসলমান ও তাদের মাতৃভূমির সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি যে কর্তৃপক্ষ আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে একটি রেখা টেনে দিয়েছি, যেটিকে ইতোমধ্যেই প্রান্তিক হয়ে যাওয়া একটি সম্প্রদায়কে আরো কোণঠাসা করে রাখার উপায় হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
নিরাপত্তা কর্মকর্তার সাথে এই ঘটনার পর আমাকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনো আমার কান্না থামছিল না, মূলত সে কারণেই একজন ব্যবস্থাপকের কাছে আমাকে পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী ও বন্ধুসুলভ, তবে এই ঘটনাকে তিনি বিমানবন্দর নিরাপত্তাব্যবস্থার অংশ হিসেবেই দেখলেন। তিনি ধারণা করেন, আমাকে জেরা করার মূল কারণ ছিল ‘আমি একজন মুসলমান তরুণী’ এবং একজন জঙ্গির সম্ভাব্য কনে হতে পারি।
প্রকৃত ঘটনা হলো, আমি একজন তরুণী এবং আমার মাথায় ওড়না ছিল। কিন্তু মুসলিম না হয়ে আমরা যদি অন্য কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হই তখন কি এমনটা হবে? কেউ কি একবারও বলবে যে ‘তোমাকে জেরা করা হয়েছে। কারণ তুমি একজন ইহুদি তরুণী, তাই আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না?’
এটা সত্যিই হতাশাজনক যে, আপনার নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বে রয়েছেন যিনি তিনিই যদি একজন অপরাধীর সাথে যে ধরনের আচরণ করেন আপনার সাথেও অনুরূপ আচরণ করেন। দৈনিন্দন ইসলামভীতি মোকাবেলা করতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে এটি বিদ্যমান থাকার কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এটি যদি করতে পারি তাহলেই আমরা চূড়ান্তভাবে সহনশীলতা ও বহু মতের মূল্যবোধকে সংস্কার করার কাজ শুরু করতে পারব। আর এ মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই ব্রিটেনের সৃষ্টি হয়েছে।