পহেলা বৈশাখের বর্তমান আয়োজন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিলে না

Boishakhমোহাম্মদ জাফর ইকবাল: বাংলা নববর্ষ। বছর ঘুরে আবার এসেছে ফেলে আসা জীবন পাতার হিসাব মেলানোর জন্য। অতীতের সব গ্লানি ও অন্যায়কে ভুলে গিয়ে নতুন করে সত্যের পক্ষে চলার জন্য। কিন্তু আমরা সেটা না করে হারিয়ে যাই নানান অপসংস্কৃতিতে। আমরা ভুলে যাই, বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির সাথে জড়িয়ে থাকা মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা। আমরা বাংলা নববর্ষে নতুন বছরকে বরণ করার নামে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে যে দৃশ্য দেখি তাতে মুসলিম নয়, প্রতিফলিত হয় পৌত্তলিক সংস্কৃতির নানান আচার অনুষ্ঠান। অথচ এ কথা কারো অজানা নয়, হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে, বাংলা বর্ষপঞ্জি ১৫৮৪ ঈসায়ী বা খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট আকবর এর প্রবর্তন করেছেন। এই দিন সম্রাট আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সিংহাসনে আরোহণের ঐতিহাসিক মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এ দিন থেকে গণনা শুরু করা হয়। তখন এ নতুন সালের নাম ছিল তারিখ-ই-এলাহী। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন আকবরের এ বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখা এবং রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে এ নতুন সনের প্রবর্তন করা হয়। এছাড়া নববর্ষ একজন সচেতন মানুষ এই চিন্তা করাতে পারেন যে, গত এক বছরে সমাজ ও ব্যক্তি-জীবনে যে পরিবর্তন বা উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তা সাধিত হয়েছে কিনা। যদি উন্নতি কিছু ঘটে থাকে তাহলে আরো উন্নতি কিভাবে করা যায় তা নিয়ে ভাবতে শেখায়। আর যদি উন্নতি না হয়ে থাকে তাহলে কেন অবনতি ঘটলো এবং কি কি সংস্কার আনা উচিত তা নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ধর্ম, সংস্কৃতি, উৎপাদন ও কৃষক সমাজের প্রসঙ্গ চলে আসে। নতুন বছরে মানুষের মনে জাগে নতুন আশাবাদ। গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন আয়োজনে থাকে সমৃদ্ধ। কিন্তু এখন বৈশাখ উপলক্ষে খুব ঘটা করে বের করা হয় মঙ্গল-শোভাযাত্রা। বিশাল আয়োজনের এ শোভাযাত্রায় ময়ূর, পেঁচা, কুমিরসহ নানা পশু-পাখির প্রতিকৃতি ও মুখোশের সমাবেশ ঘটানো হয়। এই মঙ্গল মিছিলের যে রূপ ও আবহ তা গ্রামবাংলার ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিলে না। কৃত্রিম এ শোভাযাত্রায় বিশেষ ঘরানার রাজনৈতিক চেতনাও লক্ষ্য করা যায়, যা সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে যায় না। আর যে বিষয়টি প্রকট হয়ে ধরা পড়ে তা হলো, এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের মনে আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদের যে চেতনা, তার বিপরীত ধারায় পরিচালিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় পশু-পাখির যে প্রতিকৃতি বা মুখোশ তার সাথে টোটেম-বিশ্বাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পশু-পাখির প্রতিকৃতি বা মুখোশের মাঝে কোনো মঙ্গল বা কল্যাণ খুঁজে পায় না। সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসেও বলা হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ একসময়ে বিভিন্ন পশু-পাখিকে পুজা করতো এবং তাদের কাছে মঙ্গল বা কল্যাণ ভিক্ষা করতো। তাহলে তাদের আবার মঙ্গল-শোভাযাত্রার মাধ্যমে পেছনের দিকে ডাকা হচ্ছে কেন? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এদেশের ইসলামবিদ্বেষী কিছু মানুষ সরাসরি ইসলামের তাওহিদ বা ‘একত্ববাদ’ চেতনার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস না পেলেও নববর্ষ উপলক্ষে বাঙালীয়ানার নাম করে পশু-পাখির প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল-শোভাযাত্রার আড়ালে ভিন্ন সংস্কৃতির একটি মিশ্রণ ঘটাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কৌশলে।
কোন কিছু ভিনদেশী হলেই তা নিন্দনীয় নয়। কিন্তু ভিনদেশী অপসংস্কৃতি যদি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিমূল নাড়িয়ে দিতে চায় তাহলে তাকে নিন্দা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে ভিনদেশী সংস্কৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজাতীয় সংস্কৃতি বিধায় একে আমরা কোনক্রমেই লালন করতে পারি না বরং তা একেবারেই পরিত্যাজ্য। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আমাদের দেশে অনেক বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে যা অতীতে ছিল না। হিংস্রপ্রাণীর মুখোশ পরা, উল্কি আঁকা, ঢাক পেটানো- এগুলো আমাদের সংস্কৃতির সাথে মোটেই সংশ্লিষ্ট নয়। এ সবের মূলোৎপাটনে জোরদার ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন। বাংলা নববর্ষে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে যত করুণ কাহিনীই রচিত হোক না কেন এ নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দেয়ার পরিণাম ফল কখনো শুভ হয় না, হতে পারে না। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় মঙ্গল ও কল্যাণের যে কথা প্রচার করা হয়, তার প্রভাব এই শোভাযাত্রার সমর্থকদের অনেকের মধ্যেই তেমন লক্ষ্য করা যায় না। যদি মঙ্গলশোভা যাত্রার মাধ্যমে আমাদের অজাচার, অনাচার দূর হতো তাহলে বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে হামলা, শ্লীলতাহানি ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটতো না।
আর মাত্র দুই দিন পরেই পহেলা বৈশাখ। বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী এই দিনটিকে বরণ প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। পান্তা-ইলিশ খাওয়া থেকে বৈশাখী মেলায় ঘুরে বেড়ানো পর্যন্ত সবকিছুর জন্যই প্রস্তুতি নিয়েছে এক শ্রেণীর মানুষ। অনেকে নতুন কাপড়-চোপড়ও কিনেছে। সব মিলিয়ে বিশেষ করে শহুরে অবস্থাপন্নদের জন্য এবারের পহেলা বৈশাখ আনন্দের একটি দিনে পরিণত হতে চলেছে। তবে দেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা তাতে বৈশাখের আনন্দে যে কেউই নেই তা নিশ্চিত করে বলা চলে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই আনন্দ উপভোগ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় কিছু শহরের বৈশাখী মেলা ও অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে নববর্ষের মূল চেতনাকে যেন একেবারে অস্বীকারই করা হয়। যেমন রাজধানীতে নববর্ষের উৎসব শুরু হয় রমনার বটমূলে। সেখানে পান্তা-ইলিশ ভোজনের মধ্য দিয়ে বাঙালিয়ানা দেখানোর বিলাসিতা করেন এক শ্রেণীর মানুষ। তারা পহেলা বৈশাখকে বেছে নিয়েছেন টাকা দেখানোর এবং বিলাসিতা করার উপলক্ষ হিসেবে। অথচ পান্তা-ইলিশ খাওয়া কখনো গ্রাম বাংলার তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য ছিল না। গ্রাম বাংলার কোনো অঞ্চলেই বছরের এ সময়ে ইলিশ পাওয়া যায় না। এটা ইলিশের মওসুমও নয়। তারা পান্তা খায় নুন-পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচ দিয়ে। সেটাও খায় বাধ্য হয়ে- ভালো কিছু খাওয়ার উপায় নেই বলে। একটু অবস্থাপন্নরা হয়তো সঙ্গে সবজি ও ছোট মাছ খায়। কিন্তু কেউই ইলিশ খায় না, পায় না বলে খেতেও পারে না।
সারা পৃথিবীতেই নানা রকমের আয়োজনে নববর্ষ পালিত হয়। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ায় ইংরেজি নববর্ষটার আয়োজন থাকে মহা ধুমধামের। সেদিন উৎসাহীগণ সারা পৃথিবীকেই কাঁপিয়ে দিতে চায। সেদিন পৃথিবীতে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করা হয়। সেদিন অভিজাত শ্রেণীর অনেক যুবক-যুবতী নানান ধরনের আপত্তিকর অপকর্মে লিপ্ত হয়। আমাদের দেশে জাতীয়ভাবেই বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। এটার রেওয়াজ বহু পুরনো। বর্তমান সময়ে নববর্ষ পালনের নামে যা হচ্ছে- তা অতি বাড়াবাড়ি। এটা এখন সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারায় নেই। এখন এটা হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক। সারা বছর যারা শাহী খাবার খেতে অভ্যস্ত তারা সেদিন রাস্তা-ঘাটে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় পান্তা খেয়ে গরিবদের সাথে উপহাসই করছে। সেদিন পান্তা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এই নববর্ষকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজিরও মহা ধুম পড়ে যায়। বিভিন্ন নামের সংগঠন তৈরি করে নববর্ষ পালন করতে চাঁদাবাজি করা হয়। ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটিও বেপরোয়াভাবে চাঁদাবাজি করে।
এবার নতুন বছরটি যখন শুরু হতে যাচ্ছে তখন দেশের চলছে একদলীয় শাসন। হত্যা-গুম ও রাজনৈতিক দমন-নির্যাতনের রেকর্ড গড়া হচ্ছে। কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। যেখানে আজ গণতন্ত্র মৃতপ্রায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গুম-খুনের যে ধারাবাহিকতা চলছে তা যেন এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউই এখন নিরাপদ নয়। কথায় কথায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের জীবন ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। আইনের চোখে প্রতিটি মানুষেরই অধিকার এক হলেও এখন চলছে দ্বিমুখী নীতি। পুলিশকে বিরোধী দলকে দমনের কাজে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের অবস্থা এখন শোচনীয়। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে উৎসব আনন্দের যে ইচ্ছে জাতি করেছে তাও করা সম্ভব হবেনা বলেই মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button