সোমবার সারাদেশে হরতাল দিয়েছে জামায়াত, রোববার দোয়া

কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

Qamaruzzamanজামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কামারুজ্জামানের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে কামারুজ্জামানের লাশ তার জন্মস্থান শেরপুরে পাঠিয়ে দেয়া হবে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে।
কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরবিষয়ক সরকারের নির্বাহী আদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে শানিবার বেলা পৌনে ৩টায় কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।
দণ্ড কার্যকর উপলক্ষে শানিবার সন্ধ্যার পর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হতে থাকে। বিপুলসংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ, কারারক্ষী এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। কারাগারের আশপাশ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। শানিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে নির্দিষ্ট কয়েকটি রোডে পুলিশ, সাংবাদিক, প্রশাসনের যানবাহন ছাড়া সব গাড়ি এবং লোকজনকে বের হয়ে যেতে বলা হয়।
শানিবার বিকেল ৪টার দিকে কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের কারাগারে আসা উপলক্ষে দুপুরের পর থেকেই বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক জড়ো হন। সন্ধ্যা ৭টার পর কারাগারে একটি অ্যাম্বুলেন্স (ঢাকা মেট্রো-চ ৭৪-০১২৭) প্রবেশ করে।
সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখারুজ্জামান প্রবেশ করেন। ৭টার দিকে প্রবেশ করেন অতিরিক্ত আইজিপি কর্নেল বজলুল কবির। সোয়া ৭টায় প্রবেশ করেন সহকারী সিভিল সার্জন আহসান হাবিব। পরবর্তীতে লালবাগ জোনের ডিসি, ইমাম এবং ফাঁসি কার্যকরের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যরা প্রবেশ করেন।
১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
গত ৬ এপ্রিল সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। ৮ এপ্রিল রিভিউ রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেন চার বিচারপতি। এরপর গত রাতে কার্যকর করা হলো তার মৃত্যুদণ্ড।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেন। গত বছর ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের একটি অভিযোগ বহাল রাখেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। মৃত্যুদণ্ডের আরেকটি সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করেন।
গত ৬ এপ্রিল কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত বছর ৩ নভেম্বর যে রায় দিয়েছিলেন তা চূড়ান্তভাবে বহাল থাকে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ: ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাতটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে মোট পাঁচটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়া হয়। দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, দু’টি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং অপর আরেকটি অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।
নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার এক মাসের মধ্যে আসামিপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করে। গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেন। আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ট্রাইব্যুনালের দেয়া আরেকটি মৃত্যুদণ্ডকে যাবজ্জীবন করা হয়।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
কামারুজ্জামানের আপিল শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
আপিল মামলায় কামারুজ্জামানের পক্ষে প্রধান আইনজীবী ছিলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট শিশির মো: মনির।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুর জেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
কুমারি কালিতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবন শুরু। ১৯৬৭ সালে তিনি জিকেএম ইনস্টিটিউশন থেকে চার বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭২ সালে ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৩ (১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত) সালে তিনি ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে ডিস্ট্রিংশনসহ বিএ পাস করেন। এরপর কামারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি এ বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেীণতে উত্তীর্ণ হন।
১৯৭৭ সালে কামারুজ্জামান বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮-৭৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মত ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বচিত হন। তার আগে তিনি এ সংস্থার কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ১৯৯২ সালে এ দলের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হবার আগে তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় তিনি দলের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কমিটি ও লিয়াজো কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৮৩-১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক স্বৈচারার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ১৯৯৩-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্ববাধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
শিক্ষা জীবন শেষে কামারুজ্জামান সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত হন। ১৯৮০ সালে ঢাকা ডাইজেস্ট এর নির্বাহী সম্পাদক ও ’৮১ সালে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তখনকার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানের ক্ষুরধার লেখনীর কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা সেসময় নিষিদ্ধ হয়। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়েও তিনি একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে তিনি ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
একজন তুখোড় বক্তা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে মুহম্মদ কামারুজ্জামানের। তিনি একজন সুলেখক। তার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
সোমবার সারাদেশে হরতাল দিয়েছে জামায়াত, রোববার দোয়া: এদিকে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা আখ্যা দিয়ে এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সোমবার সারাদেশে হরতালের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। সেই সাথে রোববার কামারুজ্জামানের জন্য দোয়ার কর্মসূচিও ঘোষণা করে দলটি। তবে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছে জামায়াত।
শনিবার রাতে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের পর এক বিবৃতিতে এসব কর্মসূচি ঘোষণা করেন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ।
নিজের বিবৃতিতে জামায়াতের আমির বলেন, ‘সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী চিন্তাবিদ, জনগণের প্রিয় নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ১১ এপ্রিল রাত ১০টার পরে হত্যা করেছে।’
তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা, বায়বীয় ও কাল্পনিক অভিযোগে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে। এ মামলায় দলীয় লোকদের দ্বারা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে। সাক্ষীদের পরস্পরবিরোধী ও অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য থেকে তার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর নিকট উন্মোচিত হয়।
তিনি আরো জানান, যে সোহাগপুরের কথিত ঘটনার অভিযোগে তাকে ফাঁসি কার্যকরের নামে হত্যা করা হলো তার সাথে মুহাম্মদ কামারুজামানের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বারবার বলেছেন, জীবনে কোনোদিনও তিনি সোহাগপুর যাননি। ওই এলাকায় কোনদিন তাকে দেখেছে এ ধরনের কথা কেউ বলতে পারবে না।
সরকার পরিকল্পিতভাবে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে বিচারের নামে প্রহসনের আয়োজন করে। কামারুজ্জামান তার পরিবারের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে জানিয়েছেন তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার বিচার অবশ্যই আদালতে আখিরাতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন নিজ হাতে করবেন।
উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির একজন ছাত্রকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার যে মহাষড়যন্ত্র ও তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার যে ব্যবস্থা আওয়ামী সরকার করেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
মকবুল আহমাদ বলেন, ‘আমরা সরকারের এই চক্রান্ত ও বীভৎস হত্যার নিন্দা, প্রতিবাদ এবং ধিক্কার জানাই। কামারুজ্জামানের রক্ত বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিকট অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তার রক্ত বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে নিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।
যারা ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করেছে এবং ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছে ইতিহাস কখনো তাদেরকে ক্ষমা করবে না। এই জালেম সরকারকে বিচারের নামে অবিচারের এবং পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জনতার আদালতে একদিন জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি এ হত্যার প্রতিবাদে ঘোষিত কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে সফল করে তোলার জন্য জামায়াতে ইসলামীর সকল জনশক্তি ও দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button