মাহে রমযানের প্রথম দিনে সর্বত্র ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতার ছোঁয়া
সাদেকুর রহমান : সকাল দশটায় রামপুরা বাজার থেকে মতিঝিল অফিসে যাচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তা আমিনুল হক। সরকারি স্টাফ বাসে করে তিনি যাচ্ছেন। একই গাড়ির যাত্রী পীর ইয়ামেনী মার্কেটের হৃদয় পাঞ্জাবীর মালিক। এ দুইজনেই অভিন্ন কণ্ঠে বললেন, রোজা শুরু হওয়ায় এখনও রাস্তাঘাটে মানুষ কম। সেহরী খেয়ে ও ফজরের নামায আদায় করে রোজাদাররা একটু ঘুমিয়ে নেয়ায় ব্যবসাযী, চাকরিজীবী সবাই ঘর থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার পবিত্র মাহে রমযানের প্রথম দিন আসলেই রাজধানীতে রোজার প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। এমন প্রভাব বরাবরই থাকে, বলা যায় চিরন্তন। সরেজমিনে রামপুরা, হাজীপাড়া, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ বাজার ও মোড়, শান্তিনগর, কাকরাইল, বিজয়নগর, পল্টন ও গুলিস্তান পরিদর্শনকালে দেখা যায়, সর্বত্রই রমযানের পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা। খাবার হোটেলগুলোতে পর্দা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। ফুটপাতে অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ কোনো খাবার দোকান বসেনি। যদি তারা বিকাল পড়তে খুলতে শুরু করে। লেবুর রসের শরবতের কারবারীদের আনাগোনাও অনেক কমে গেছে। অনেক রোজাদার মুসল্লিই গায়ে পাঞ্জাবী জড়িয়েছেন, মাথায় টুপি দিয়েছেন। প্রকাশ্যে পানাহার তো দূরের কথা ধূমপানের কোনো দৃশ্যও চোখে পড়েনি। সর্বত্রই যেনো বদলে যাওয়ার দৃশ্যপটে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, উৎসবমুখরতা ও পবিত্রতার ছোঁয়া।
সারা জাহানের মালিক আল্লাহতায়ালা এই মাসটি উত্তম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তাই মুসলমানরা এই মাসটিকে অতি সম্মানের মাস হিসেবে বিবেচনা করে। সংগত কারণেই রোযা পালন ও সংশ্লিষ্ট ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলে রমযানের প্রতি সম্মান দেখাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ব্যক্তিগতভাবে, কখনো কখনো সমষ্টিগত বা সাংগঠনিকভাবে উদ্যোগী হন। মাহে রমযানের পবিত্রতা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ইতোমধ্যে বেশ ক’জন ইসলামী আন্দোলনের নেতা বিবৃতি দিয়েছেন এবং কয়েকটি সংগঠন পোস্টারিং করেছে। গতকাল রোজার প্রথম দিন যানবাহনে বাক-বিত-াও অনেক কম হয়েছে। কেউ অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ করতে চাইলে রোজাদার ব্যক্তি প্রতিপক্ষকে সবিনয়ে জানিয়ে দেন ‘ভাই আমি রোজাদার।’ বাস, রিকশা বা অন্য কোনো যানবাহনেও ভাড়া সংক্রান্ত অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা কম ব্যয় করা হয়েছে বলে জানা যায়।
দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের কয়েকটি মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে একটু বিলম্বে আসলেও সবার মধ্যে তা পুষিয়ে নেয়ার একটা ইচ্ছা রয়েছে। অনেকেই মাথায় টুপি দিয়েছেন। কথা-বার্তার মধ্যেও অবিশ্বাস্য সংযতভাব দেখা গেছে। মাহে রমযান উপলক্ষে সরকারি অফিস সময়সূচি করা হয়েছে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। অফিস সময় কমিয়ে আনার বিষয়টি মাথায় রেখে অনেকেই অহেতুক আড্ডা বাদ দিয়ে শুধুই দাফতরিক কাজে মনোনিবেশ করেন। যোহর নামায আদায় শেষে প্রায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীই যার যার বাসায় টেলিফোনে ইফতার আয়োজনের খোঁজ-খবর নেন।
আরবী তথা হিজরী সালের বারো মাসের অন্যতম মাস রমযান। বিভিন্ন কারণে এই রমযান মাসটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ মাসকে বলা হয় সংযম, ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস। আর রমযান মাসেই নাযিল হয় শ্রেষ্ঠতম আসমানী কিতাব আল-কুরআন। আর এ মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় এক রাতকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম হিসেবে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর সেই রাতে কোটি কোটি মুসলমান সারারাত ইবাদত-বন্দেগী করে পরম করুণাময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় এবং সারা জীবনের পাপ মোচনের জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানায়। তবে ইসলামী প-িতগণের মতে সেই শ্রেষ্ঠ রজনী পবিত্র শবে কদরের বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্য ২৬ রমযান দিবাগত রাতে প্রতীয়মান হওয়ায় সে রাতকেই কেন্দ্র করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আগ্রহ থাকে একটু বেশি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবার রমযান মাসে আগামী ৫ আগস্ট সোমবার দিবাগত রাতে সরাদেশে মহিমান্বিত রজনী পবিত্র শবে কদর উদযাপিত হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দুইদিন আগেই এক বিশেষ বাণীতে বিশ্ব মুসলমানদের রমযানুল মোবারক জানিয়েছেন। আর গতকাল ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা এক বার্তায় সকল বাংলাদেশীর প্রতি একটি শান্তিময় ও উপলব্ধিপূর্ণ রমযানের হৃদয় ছোঁয়া শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বার্তায় তিনি বলেন, “ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সকল পক্ষ থেকে, আমার স্ত্রী গ্লেস ও আমাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সবাইকে জানাই রমযান করিম।”
প্রথম রোজার দিন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের সকল মসজিদেই ওয়াক্তিয়া নামাযগুলোতে মুসল্লিতে ভিড় ছিল। আজ দ্বিতীয় দিন জুমার নামাযে অংশ নিতে মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের ঢল নামবে বলে আশা করা হচ্ছে। অতীত এটাই বলে, মাহে রমযানের প্রথম কয়েকদিন ও শেষ দিনগুলোতে মসজিদে মুসল্লিদের পদভার তুলনামুলক বেশি পড়ে। নামায পড়ার সাথে সাথে কুরআন তেলাওয়াতসহ নফল ইবাদতের মাত্রাও এ মাসে বেড়ে যায়। রমযান মাসকেন্দ্রিক কুরআন শরীফ, রেহাল, টুপি, মেসওয়াক, হাদীস-ধর্মীয় বই, আতর ইত্যাদি বেচা-কেনা অনেক বেড়ে যায়। বায়তুল মোকাররমে দক্ষিণ গেটের সংশ্লিষ্ট দোকানীরা এ তথ্য দিয়ে বলেন, বছরের মোট বেচা-কেনার প্রায় অর্ধেক তারা রোযার মাসেই করে থাকেন।
ঢাকা মহানগরী পুলিশের পক্ষ থেকে যান ও পথচারী চলাচল নির্বিঘেœ করতে ফুটপাত ও রাস্তার ধারে ইফতার সামগ্রীর দোকান বসাতে নিরুৎসাহিত করা হলেও নানা বাস্তবতায় প্রথম দিন থেকেই তা অমান্য হয়ে যায়। বিকাল থেকে গোটা রাজধানী পরিণত হয় এক বৃহৎ ইফতার বাজারে। পবিত্র মাহে রমযানের জন্য এটিও অনন্য সওগাত।