আজান শুনে যেভাবে ইসলাম গ্রহণ করলেন ইহুদি নারী সান্দ্রা

Sandraমানুষ কত ভাবেই না ইসলামের ছায়াতলে আসছেন, কেউবা ইন্টারনেটে কোরআন পড়ে, আবার কেউ আল্লাহর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। আবার অনেকে আজানের মধুর ধ্বনি শুনে। এমনি এক ইহুদি নারী সান্দ্রা নাউয়ি। তিনি শান্তির সন্ধানে ছুটেছেন দেশ-দেশান্তরে। জীবন কাটছিল নানা বাধা-বিঘ্নতার মধ্য দিয়ে। অবশেষে আজানের মধুর ধ্বনি তার মনে আনে পরিপূর্ণ শান্তি, খুঁজে পান ইসলামের পরশ।
ইসলাম গ্রহণে কেউ তাকে বাধ্য করেনি। এমনকি হিজাব পরতেও কেউ তাকে বলেননি। তিনি নিজেই হিজাবকে বেছে নিয়েছেন। সান্দ্রা নাউয়ি ইসলাম গ্রহণ করেছেন তিনি।
ইসলামের পথে তার যাত্রার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা :
আমার জীবনে সবসময়ই কিছু একটার অভাব অনুভব করতাম। আমি ধর্মের অর্থ খুঁজতে সচেষ্ট হই-কিন্তু সব ভুল জায়গায় এবং সব ভুল উপায়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইউরোপ অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। যুদ্ধের সময় আমার পরিবার লুকিয়ে ছিল। আমার পিতামহকে বন্দী করার পর তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় আমার মা তার পিতাকে হারায়। ১৯৫৭ সালে আমার বাবা-মা জার্মানির ম্যানহেইম থেকে কানাডায় চলে যায়। আমার বাব-মা ইহুদি এবং ইহুদি পরিবারেই আমার জন্ম।
যুদ্ধের পর আমার বাবা-মা উভয় বেশ তিক্ত ছিল এবং অনেকটা বাধ্য হয়েই নতুন দেশে একটি নতুন জীবন শুরু করতে চেষ্টা করে। তারা কানাডায় কানাডিয়ানদের মত হতে কঠোর চেষ্টা করে। তারা সেখানে তাদের নাম পরিবর্তন করে এবং তাদের ঐতিহ্যকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রাখে। আমি আমার বাবা-মা থেকে ভিন্ন ছিলাম। আমি আমার ইহুদি বিশ্বাসকেই গ্রহণ করি কিন্তু আমি তখনও কিছু একটার সন্ধানে ছিলাম। আমি জানি না সেটা কি।
যখন আমার অনুসন্ধান শেষ, সান্দ্রা তখন আর নেই। সান্দ্রার স্থান দখল করে হয় সালমা। ইহুদি ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করার সময় আমি সালমা নামটি বেছে নেই। কেননা সালমা (উম্মে সালমা) ছিলেন মহানবীর (সা:) স্ত্রীদের একজন এবং তিনি ছিলেন প্রতিপালক।
তিনি ছিলেন এমন একজন নারী যিনি সবাইকে দেখাশোনা করতেন এবং এটি আমার নিজের নামের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ। কেননা আমি আমার সান্দ্রা নামের অর্থ অনুসন্ধান করে জেনেছি, সান্দ্রা মানে মানবজাতির সাহায্যকারী।
ইসলামে প্রথম পরিচয়
সম্ভবত আমার যখন ১৩ বছর বয়স, তখন ক্যাট স্টিভেন্স নামে এক লোকের কথা জানতে পারি যিনি ইসলামে ধর্মান্তুরিত হয়েছিল এবং যিনি এখন ইউসুফ ইসলাম নামে পরিচিত। আমাকে তার এই বিষয়টি মুগ্ধ করে এবং তখন থেকেই ইসলাম সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি।
আজানের মধুর ধ্বনি
২০০৫ সালে আমি ভারত যাই। এটি ছিল আমার মায়ের মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর। আমি যখন সেখানে যাই তখন ছিল রমজান মাস। সেখানে প্রথম রাতে আমি ঘুমোতে যাই। ভোর ৫ টায় আজানের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজানের শব্দের বিশাল শক্তি আমাকে মুগ্ধ করে। আমি আসলে কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দূর থেকে ভেসে আসা এই আজান আমার মনে পরিপূর্ণ সুখ, শান্তিু ও একাত্মতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আমি আনন্দে কেঁদে ফেলি। আমার এই কান্না ছিল বিশ্বাসের কান্না।
কালেমা পাঠ
আমি কালেমা শাহাদা পাঠ করতে এক ইমামের দ্বারস্থ হই। তার নিকট গেলে তিনি আমাকে এই সর্ম্পকে ধারণা দেন। তিনি আমাকে বলেন, ‘কালেমা শাহাদা হচ্ছে ইসলামের একটি ঘোষণা। এটি কেবলমাত্র একটি স্বীকৃতি। এটি হল তাই যা আপনি বিশ্বাস করেন। আপনি ইসলামের প্রতি আপনার বিশ্বাস ঘোষণা করেছেন এবং আপনাকে নিম্নলিখিত দুটি বাক্য বলতে হবে যা সাক্ষ্য হিসেবে বহন করবে। আর তা হল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ (সা:)তার রাসূল।’
বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে আমরা এটি করতে অগ্রসর হলাম এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিকট তার আশীর্বাদ চাইলাম এবং ঐ আনন্দের মুহূর্তে আমরা সবাই সাক্ষী হলাম। আমি ইমামের সাথে সাথে বললাম, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান রাসুল আল্লাহ। তিনি আমাকে এর অর্থ করে শুনালেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ (সা:) তার রাসুল।
আমার শাহাদা পাঠের পর তিনি আমাকে অভিনন্দন জানান। তিনি বললেন, ‘জাজাক আল্লাহ খায়রান। আল্লাহ আকবর, আলহামদুলিল্লাহ।
হিজাব পরিধান
আমি প্রথম যখন হিজাব পরতে শুরু করি, প্রথম চার সপ্তাহ ভয়ঙ্কর স্নায়ুবিক দুর্বলতায় ভুগতাম। আমার কথা এবং চিন্তুা সম্পর্কে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে এটি ভেবেই স্নায়ুবিক অস্বস্তিতে ভুগতাম। কিন্তু প্রথম এই চার সপ্তাহ পরেই স্বস্তিবোধ করি। হিজাবের প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়ায় আমি ক্রমাগত বিস্মিত হয়েছি। সমস্যাটি হল উত্তর আমেরিকার মানুষেরা হিজাব পরিহিত নারীকে নিপীড়িত এবং পরাধীন হিসেবে মনে করেন। হয়তো কিছু দেশে কিংবা কিছু শাসন ব্যবস্থায় এটি সত্য হতে পারে কিন্তু কানাডার জন্য নয়। এখানে আমাদের পছন্দের স্বাধীনতা রয়েছে এবং আমি এটিই বেছে নিয়েছি।
দুঃখের বিষয় হল, আমার সবচেয়ে খারাপ এক অভিজ্ঞতা হয়েছে যা আমি মুসলিম সম্প্রদায় থেকে পেয়েছি। এক শুক্রবার আমি জুমার নামাজের জন্য বের হই। পথিমধ্যে আমার ফোন বেজে ওঠে এবং এটি ছিল একজন মুসলিম মহিলার ফোন। তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনি এখনও হিজাব পরেন?’ আমি তাকে উত্তরে বললাম ‘হ্যাঁ’ এবং তিনি আমাকে বললেন, ‘ও আচ্ছা, আমার সব বন্ধুরা তো হতবাক কেমন করে এক শ্বেতাঙ্গ মেয়ে মুসলিম হওয়ার ভান করছে।’
তাদের এই ধরনের মন্তুব্য আমার হৃদয়ে আঘাত করে। এই কারণে যে আমি কোনো ভান করছি না। আমি উত্তর আমেরিকান হওয়ার কারণে লোকজন সবসময় এমনটি মনে করে থাকে এবং তারা মনে করে, আমি ইসলামে ধর্মান্তুরিত হয়ে রাজনৈতিক বিবৃতি সৃষ্টি করছি। কিন্তু আমি মনে করি বিবৃতি সৃষ্টি করার চেয়েও বড় কথা হল আমি কে। আমি একজন মুসলিম এবং আমি হিজাব পরিধানকেই বেছে নিয়েছি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button