ধর্মীয় সম্প্রীতিতে বাংলাদেশ আদর্শ দৃষ্টান্ত
প্রীতিময় বাংলাদেশ গড়ায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বানের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলো সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা’র ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সম্প্রীতি সম্মেলন। এতে সর্বধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্টজনেরা বলেন, বিশ্বের সব ধর্মেই শান্তির কথা বলা হয়েছে। কোন ধর্মেই হিংসা হানাহানির কথা নেই। বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে হাজার বছরের একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত। মাঝে মাঝে গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মহল ধর্মীয় সম্প্রীতিতে কুটিল আঘাত হানার চেষ্টা করলেও ধর্মপ্রাণ মানুষেরা তা ঐক্যের প্রাচীরের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে তারা এ কথা বলেন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ, জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও থিম সং এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ১০টায়। ওয়েবটিভি নরমবুবনফ.পড়স অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে। সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভার চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস ইন বংলাদেশের ডেপুটি হেড অফ ডেলিগেশন মি. দার্কো জর্দানভ, পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার সামিনা মেহতাব, ঢাকাস্থ রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের ফার্স্ট সেক্রেটারি মি. এন্ড্রে ব্যানকায়েভ, ইরানি রাষ্ট্রদূতের প্রেস অফিসার মোঃ বেলাল হোসাইন, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের, আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও, সিএসসি, ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহকারী মহাসচিব স্বামী গুরু সেবানন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান, বাংলাদেশ আন্তঃধর্মীয় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ব্রাদার জারলাথ ডি সুজা, বিশিষ্ট সংগঠক কবি আল মুজাহিদী, কর্নেল (অব.) আশরাফ আল দ্বীন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহ্মেদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কো-চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সুকমল বড়ুয়া, লে. কর্নেল সৈয়দ আলী আহমদ (অবঃ) প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মের বিভিন্ন গণ্যমান্য ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ।
সংগঠনের মহিলা সম্পাদিকা ব্যারিস্টার ফাতিমা আনোয়ার ও সদস্য আহসান হাবীব খানের উপস্থাপনায় অতিথিবৃন্দের বক্তব্যের পর ২০১৪ এর বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভার জেনারেল সেক্রেটারি শরীফ বায়জীদ মাহমুদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সংগঠনের কো-চেয়ারম্যান বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্কাইপের মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন অস্ট্রেরিয়ার চার্লস স্টার্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক শিবলি আব্দুল্লাহ এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ল’ স্কুলের শিক্ষক মোঃ ওয়াহিদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সকল ধর্মীয় সম্প্রীতির সহস্র বছরের একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এবং মুসলমান ধর্মীয় নেতারা ভাই ভাই হিসাবে, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সহকারে নিজ নিজ ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন। যদিও মাঝে মাঝে গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মহল এ সুসম্পর্কের ভিতে কুটিল আঘাত হানার চেষ্টা করেছে – কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা তাদের সে সব চক্রান্ত ঐক্যের প্রাচীরের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রসের মি. দার্কো জর্দানভ বলেন, ইতিহাস বলে যে বাংলাদেশ কয়েক সহস্র বছর ধরে সকল ধর্মের লোক সুখে শান্তিতে নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করে অবস্থান করে আসছে। এটা পৃথিবীর জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।
পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার সামিনা মেহতাব বলেন, আমরা সকল ধর্মের লোকই এক আদম এবং হাওয়ার সন্তান, সুতরাং আমরা সবাই এক মানব পরিবারের সদস্য। আমাদের মধ্যে সম্প্রীতি বজয় রাখা খুবই জরুরি, যা ভ্রাতৃত্ব বোধের পরিচায়ক।
ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের স্বামী গুরু সেবানন্দ বলেন, মহাম্মদ, গৌতমবুদ্ধ, যিশুখৃষ্ট এবং হিন্দু ধর্মের সকল অবতারগণ মানুষের সম্মানকে সর্বচ্চে স্থান দেয়ার শিক্ষাই দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় ধর্ম মানবধর্ম।
আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও বক্তব্যে বলেন, আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বাংলাদেশে সকল ধর্মের অধিকার প্রতিষ্ঠিত আছে। তবে গত ৪-৫ বছরে কিছু দুষ্কৃতকারী কিছুটা হতাশা আনার চেষ্টা করলেও সরকার এবং সর্বধর্মীয় সম্প্রীতির মাধ্যমে তা উত্তরণ করা গেছে। এ ক্ষেত্রে আমদের সকল ধর্মের অনুসারীদের রিলিজিয়াস ফাউন্ডেশন বা ধর্মীয় ভিত যে শিক্ষা দেয় তা হল পরমত সহিষ্ণুতা এবং নিজ নিজ ধর্মের সশ্রদ্ধ চর্চা ও অনুশীলন।
সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের বলেন, জন্ম জন্মাতরে শুদ্ধি লাভ এবং সৃষ্টিকর্তার ধ্যান হচ্ছে সকল শান্তির চাবিকাঠি। ত্রিপিটক, কোরআন, বাইবেল, গীতা সহ সকল ধর্মগ্রন্থে মানুষের সম্মান প্রদান এবং অন্যায় বিবেকহীনতার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে থাকার শিক্ষা দেয়। আমরা বন্ধুতা, ভ্রাতৃত্ব চাই এবং সকল ধর্মের নিরবচ্ছিন্ন চর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষিত হোক এটাই কামনা করি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, প্রতিটি ধর্মে পার্থক্য রয়েছে। আমরা সব ধর্মকে এক করতে চাই না। সবাই যাতে তার নিজ ধর্ম পালন করতে পারে সে পরিবেশ চাই। সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে চাই। যথাযথ ধার্মিক ব্যক্তি কখনো অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে হামলা করতে পারে না।
সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভার জেনারেল সেক্রেটারি শরীফ বায়জীদ মাহমুদ সম্মেলনের প্রস্তবনা উপস্থাপন করেন। সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবগুলো হলো : ১. সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা মনে করে যে, দুর্ভাগ্যবশত দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্প্রীতির অভাব অত্যন্ত প্রকট। এই বাস্তবতা যাতে বাংলাদেশের চিরায়ত ধর্মীয় সম্প্রীতিকে ক্ষুণ্ন করতে না পারে তার জন্য ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। ২.সম্প্রীতি সভা সকলকে নিজ নিজ ধর্ম পালনে উদ্বুদ্ধ করতে এবং ধর্ম চর্চার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি সুদৃঢ় করতে প্রচেষ্টা চালাবে। ৩. জাতীয় ঐক্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা তার কার্যক্রমকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেবে। ৪.যে সব আইনের কারণে, জমি সংক্রান্ত বিরোধ সারা দেশে সম্প্রীতি নষ্ট করছে,সেই আইনগুলো সংস্কারের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে। ৫.এই সম্মেলন গত ১০ এপ্রিল বরিশাল শহরের কোর্টপাড়াস্থ সেন্ট পিটার চার্চের জমি, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা জোর পূর্বক দখলের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং অনতি বিলম্বে তা চার্চ কর্তৃপক্ষকে ফেরত দেয়ার জোর দাবী জানাচ্ছে। এবং ৬. বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর যে সব নগ্ন হামলা হয়েছে, তার তীব্র নিন্দা এবং দুস্কৃতিকারীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদানের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে।
সমাপনী বক্তব্যে বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেন, সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে শান্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় কামনা এবং ধ্যান। তাই আমাদের দেশের সকল মানুষের শান্তি কামনা করেই সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা কাজ করে যাচ্ছে। আমি এই প্রতিষ্ঠানের উত্তর উত্তর সাফল্য কামনা করি।
সম্মেলনের ২য় অধিবেশনে কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন, ঢাকা মহানগরী কমিটি গঠনসহ সাংগঠনিক বিবিধ বিষয়ে আলোচনা হয়। ঢাকা মহানগরী কমিটি আহবায়ক মনোনীত করা হয় কর্নেল (অব.) আশরাফ আল দীনকে। এছাড়া যুগ্ম আহবায়ক ফাদার রেভারেন্ড সৌরভ ফলিয়া, ইঞ্জিনিয়ার দিব্যেন্দু বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, এডভোকেট ঝুলন কান্তি পাল এবং আবেদুর রহমানকে সদস্য সচিব মনোনীত করা হয়েছে।