মাদকের নীল নেশা : আতঙ্কে অভিভাবকরা
সাখাওয়াত হোসেন : মাদকের সহজলভ্যতায় উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন প্রকার মাদক সেবনের প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পুলিশ ও বিজিবি’র নাকের ডগায় অবাধে দেশের সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে মাদকদ্রব্য। আর মাদক ব্যবসায়ী চক্রকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা। সরকার পরিবর্তন হলেও মাদক ব্যবসায়ী চক্রের কোন পরিবর্তন হয় না। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীসহ উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একটি বড় অংশ এখন মাদকাসক্ত। নেশার অর্থের যোগান দিতে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এ সব মাদকাসক্ত। এমনকি নিজের মা-বাবাকেও খুন করতে দ্বিধা করছে না তারা। সম্প্রতি ইয়াবা আসক্ত মেয়ে ঐশী বাবা পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না বেগমকে মাদকাসক্ত বন্ধুদের নিয়ে নির্মমভাবে খুন করে। তবে এ জোড়া খুনের নেপথ্যে আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে তদন্তকারী ডিবি’র কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হতাশাগ্রস্ত বেকার থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা নিষিদ্ধ মাদকের নীল নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। মাদকের থাবা যেভাবে ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে তা অভিভাবক ও সচেতন মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এমনকি সমাজের নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরাও দিনদিন মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ভারত ও মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রতিবছর দেশে অবৈধভাবে ঢুকছে শত শত কোটি টাকার ইয়াবা-ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। এ জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন ভারতে ফেন্সিডিল কারখানা এবং মায়ানমারে ইয়াবা কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ফেন্সিডিল ও ইয়াবা কারখানা থেকে শুধু বাংলাদেশেই শত শত কোটি টাকার মাদক পাচার করা হচ্ছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, কতিপয় বিজিবি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। অথচ সরকার নির্বিকার। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সকলকেই মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, মাদকের অপব্যবহার আমাদের সমাজে এখন একটি বড় ধরনের সমস্যা। সমাজের নানা বয়সের মানুষ ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসহ নানা মাদকে আসক্ত। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদক প্রতিরোধে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া মাদক প্রতিরোধ করা কঠিন কাজ। এ জন্য পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদক প্রতিরোধে যারাই এগিয়ে আসবেন আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের আইনগত সহায়তা প্রদান করা হবে।
আইজিপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মাদক প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশ দিয়েছেন। আমরা চেষ্টা করছি। এ জন্য সকলের সহযোগিতা ও সচেতনতা আবশ্যক।
পুলিশ বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার সহযোগিতায় সীমান্ত দিয়ে মাদক আসছে এবং রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বিক্রি হচ্ছে এ বিষয়ে পুলিশ প্রধান হিসেবে আপনি কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, আমাদের সীমান্তের অধিকাংশই উন্মুক্ত। বিজিবি ও পুলিশ চেষ্টা করছে মাদক প্রতিরোধে। কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত লোক রয়েছে আমরা তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। মাদকের ব্যাপারে পুলিশ সারা দেশেই জিরো টলারেন্স দিয়ে কাজ করছে।
ভয়াবহ ইয়াবা সেবনের কারণেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী নিজের মেয়ের হাতে খুন হয়েছেন- পুলিশ প্রধান হিসেবে বিষয়টি সম্পর্কে আপনার মতামত কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ভয়াবহতা শুধু পুলিশ বা বিজিবি নয়, সমাজের সকলকেই অনুধাবন করতে হবে। সবাই এই মাদকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। মাদকের ব্যাপারে পুলিশ কোন আপোষ করতে চায় না। কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য মাদকের সাথে জড়িত বা মাদক ব্যবসায়ীকে সহযোগিতা করছে- এমন তথ্য পাওয়া গেলে তদন্ত করে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পুলিশ সদর দফতর এ ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেবে না। মাদক সেবনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তা হলে আরো ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে আইজিপি মন্তব্য করেন।
বিজিবি’র উপ-মহাপরিচালক (অপারেশন ও প্রশিক্ষণ) কর্নেল হাফিজ আহসান ফরিদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ইয়াবাসহ সকল মাদকদ্রব্য যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। দেশে যে সীমান্ত এলাকা রয়েছে সেখানে বিজিবি’র পক্ষে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব নয়। স্থানীয় জনগণ ও সকলের প্রচেষ্টায় মাদক প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিজিবি সে দিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করছে।
সায়ীদ আমিনুল নামে একজন অভিভাবক বলেন, গুলশান, ধানমন্ডি, বনানী, হাতিরপুল, খিলগাঁও ও এর আশপাশ এলাকা এমন কী বারিধারা এবং ইদানিং বসুন্ধরা এলাকায় মাদক ও তার আনুষঙ্গিক সব কিছু হাতের নাগালে পাওয়া যায়। পুলিশ, ডিবি ও র্যাব সবাই জানে কোথায় কী হচ্ছে, এছাড়াও এখানে অবস্থিত কফি শপ, ক্যাফেটেরিয়া, হোটেল, ফ্ল্যাট ইত্যাদিতে সব কিছুই পুলিশের নাকের ডগায় হচ্ছে এবং তারা এসব অনৈতিক ও অবৈধ কর্মকান্ডের জন্য মাসোয়ারা পায়। এখন পুলিশ বাহিনীসহ সব বাহিনীর সদস্যদের চিন্তা করতে হবে তাদের পরিবারে সন্তানদের ভবিষ্যত তাদের হাতে। তারা এখন কি করবে এটাই দেখার বিষয়? তবে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আতংকে আছি।
ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, এ ঘটনার জন্য আমরা কাকে দোষারোপ করব- ঐশীকে? না দোষারোপ করব সমাজের সচেতন মহলকে যারা সমাজকে তার সামাজিক ও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে দেয়নি ! দোষারোপ করব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যারা আচরণ মূলক বিষয় ক্লাসে পাঠ করান না ! মা-বাবাও এই দোষের বাইরে নয় ! এই রকম অবস্থা শুধুমাত্র ঐশীই নয় সারাদেশে অহরহ ঐশীরা আছেন ! শুধুমাত্র মা-বাবা হলেই সবকিছু শেষ হয় না, তাদের উপর অনেক দায়িত্ব থাকে, তেমনি গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও বিরোধী দলেরও অনেক দায়িত্ব আছে। কারণ, তাদের সবকিছু জনগণ অনুসরণ করে! এই দায়িত্ব পালন না করার অর্থ হলো এই সমস্ত ঘটনার ফসল। একটি পরিবারের একটি ভাল ছেলে/মেয়ে যদি সমাজের রোষানলে পড়ে খারাপ পথে চলে যায়, তখন তার অনুসারীরাও একই পথে যাবে! একটি পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পরিবারের কোন সদস্যকে অনুসরণ করে বেড়ে ওঠে (আচরণগত ভাবেও)।
সূত্র জানায়, বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে মাদক দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের শহরে, নগরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মাদক দ্রব্যের ব্যবসা বড়ই লাভের ব্যবসা। তাইতো এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী বিজিবি ও পুলিশকে ম্যানেজ করে রাজনৈতিক দলসমূহের পৃষ্ঠপোষকতায় অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা, ধ্বংস করছে যুব সমাজকে। সম্প্রতি ইয়াবা নামক যৌন উত্তেজক এক মরণ নেশা অভিজাত ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। নিষিদ্ধ করে অভিযান চালিয়েও দমানো যাচ্ছে না। কারণ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। থাইল্যান্ডের মতো দেশে ইয়াবা আগ্রাসনকে দমন করার জন্য ৩ হাজার ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ার দিতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সরকার। বর্তমানে ইয়াবাসহ সকল প্রকার মাদক দ্রব্যের নিরাপদ ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ। যা রীতিমত আঁতকে উঠার মতো। ভাবিয়ে তুলেছে দেশের অভিভাবকসহ সচেতন জনসাধারণকে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৭৫ লক্ষ মাদকাসক্ত লোক বসবাস করে। ধূমপান ও ইয়াবা সেবীসহ এ সংখ্যা আরো কয়েকগুণ হতে পারে।
একটি সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সীমান্তে দুই শতাধিক প্রভাবশালী ইয়াবা ব্যবসায়ী জড়িত রয়েছে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকুন না কেন তাদের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। টেকনাফের সংসদ সদস্যসহ চিহ্নিত ২০ টি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ৩ শতাধিক সদস্য দেশের সর্বত্র পৌঁছে দিচ্ছে ইয়াবা। তালিকাভুক্ত ৯৭ জন গডফাদার নিয়ন্ত্রণ করছে এই সিন্ডিকেট। তারাই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে অথবা ম্যানেজ করে নিয়ে আসছে ইয়াবার চালান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শুধু ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন ইয়াবার চাহিদা রয়েছে ১৪ লাখ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে এর চাহিদা ৮ লাখ আর কক্সবাজারে ৪ লাখ। উঠতি টিএনএজ ছেলে-মেয়েরা এখন ইয়াবা আগ্রাসনের শিকার। শুধুমাত্র কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসা করে ১ শতের অধিক যুবক কোটিপতিতে পরিণত হয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাদক দ্রব্যগুলো দেশের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত হানছে। মাদকদ্রব্য জনিত কারণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়া মাদকাসক্তি জনিত রোগে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। দৈনিক মাদকাসক্তের পেছনে গড়ে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।