অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর ১২৯ বছরে
দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ ভাগ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে। দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এ বন্দর আজ পা রাখলো ১২৯ বছরে। দিবসটিকে যথাযথভাবে পালন করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ হাতে নিয়েছে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি। শনিবার সকালে বন্দর ভবনে জাতীয় এবং বন্দরের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়।
বন্দর দিবস উপলক্ষে বন্দরের মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বন্দর হাসপাতালে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। দুপুরে আয়োজন করা হয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের। রাতে অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
ঘন ঘন শ্রমিক অসন্তোষ ও পণ্য খালাসে ধীরগতিসহ নানা কারণে এক সময় দেশি বিদেশি জাহাজ মালিকদের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরটি ছিল রীতিমত আতঙ্ক। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার উন্নতির ফলে উন্নতির সূচকে এগিয়েছে চার ধাপ । এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সম্প্রতি দুটি মাইল ফলকও ছুঁয়েছে এ বন্দর।
শুরুর দিকে মাত্র একটি জেটি দিয়ে যাত্রা হলেও ১২৮ বছরে অবকাঠামো ও পৱিধি দুটোই বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই চলতি বছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং পণ্য ডেলিভারিতে ইতিহাস গড়েছে দেশের বৃহত্তম এ বন্দর।
ইতিহাসবিদদের মতে, ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ীরা বার্ষিক এক টাকা সেলামির বিনিময়ে নিজ ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন। পরে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার গঠিত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়।
১৮৯৯-১৯১০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে যুক্তভাবে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে। ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে রেলওয়ের সংযোগ সাধিত হয়। ১৯২৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে মেজর পোর্ট ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনারকে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট-এ পরিণত করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টকে চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটিতে পরিণত করা হয়। এটি একটি স্বায়িত্তশাসিত সরকারি সংস্থা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের নামকরা প্রায় বন্দরের সৃষ্টি প্রাকৃতিকভাবে। খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ৩০০ বছর আগে গ্রিস রেকর্ডে এ বন্দরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর্য যুগে ইউরোপীয় বণিকরা কর্ণফুলী মোহনায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। ইবনেবতুতা এ বন্দরকে শেটগাঙ (গঙ্গার অববাহিকা) হিসেবে উল্লেখ করেন। আরব ও ইয়েমেনি বণিকরা এ বন্দর দিয়ে পূর্বপ্রাচ্যে বাণিজ্য করতেন। পর্তুগিজরা বন্দরটির নাম দিয়েছিলেন পোর্ট গ্রান্ডে।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, ইবনে বতুতা এবং মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনীতে বেরিয়ে এসেছে চট্টগ্রাম নগরের কথা। তারাও বলেছেন, তখন চট্টগ্রাম শহর ছিল বর্ধিষ্ণু এলাকা। মার্কো পোলো তার চাচা নিকোলাই পোলোকে নিয়ে এসেছিলেন। মার্কোর ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশ হওয়ার পর চট্টগ্রামের সঙ্গে ইউরোপের নৌ-বাণিজ্য বেড়ে যায়। ভাস্কো দা গামা চট্টগ্রাম এসেছিলেন পর্তুগিজদের হয়ে। তার ভ্রমণের পর চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।
বর্তমানে দেশের আমদানি-রপ্তানির শতকরা ৯২ ভাগই চট্টগ্রাম বন্দর তথা কর্ণফুলীর মাধ্যমে হয়ে থাকে।
বছরে প্রায় আড়াই হাজার জাহাজ এ বন্দরে ভিড়ে থাকে। ফলে কর্ণফুলীর সাথে বঙ্গোপসাগরের সংযোগটি দেশের প্রাণপ্রবাহ হিসাবে স্বীকৃত।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স সভাপতি মাহবুবুল আলম বাংলামেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে বন্দরে যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি আছে সেগুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে এবং সংখ্যায় আরো বৃদ্ধি করতে হবে। নিউমুরিং কন্টেইনারটা খুব তাড়াতাড়ি চালু হওয়া দরকার।’
প্রসঙ্গত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক লয়েডস লিস্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১’শটি শীর্ষ বন্দরের মধ্যে বর্তমানে ৮৬তম অবস্থান আছে চট্টগ্রাম বন্দর। মার্চ ২০১৫ মাসে ১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯০৮টি কন্টেইনার হ্যান্ডেল করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। যা গত ১২৮ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দেশের মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার (জিডিপি) যেখানে ৬ থেকে ৭ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধির হার ২১ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্য থেকে কাস্টম হাউস গত অর্থ বছরে (২০১৩-১৪) রাজস্ব সংগ্রহ করেছে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থ বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায় হবে বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।