আল্লাহর রাহে দানে এগিয়ে যেসব নারী
আমাতে জুলজালাল: রাসূল (সা.) ইসলামের দাওয়াতের কাজ শুরু হলে তাঁর কাছে যেমন ভিড় হতে থাকে ইয়াতিম, মিসকীন, দাস ও নিঃস্ব বিধবাদের তেমনি বিভিন্ন জিহাদে ব্যয় হতে থাকে প্রচুর অর্থ সম্পদ। রাসূল (সা.) ছিলেন অর্থ-সম্পদশূন্য একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাঁর এই আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে এলেন দরাজ দিলের বিভিন্ন পুরুষ ও মহিলা সাহাবীগণ। এদের মধ্য থেকে সবার আগে স্মরণ করতে হয় হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) কে।
হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ
হযরত খাদিজা ছিলেন কোলেম বংময়ী খোয়াইলিদ বিন আসাদের কন্যা। পূত চরিত্রের জন্য তার উপাধি ছিল ‘তাহিরা’। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে তিনি দুইবার বিধবা হন। এর পর পৌঢ়া খাদিজার বিবাহের প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিতধাব ও সততায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে প্রথমে নিজ ব্যসায়ে নিয়েজিত করেন। যুবক মুহম্মদ (সা.)-এর সততা ও চারিত্রিক মাধুর্য খাদিজাকে সংকল্পচ্যুত করে এবং এক সময় রাসূলের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
খাদিজা ছিলেন একজন অত্যন্ত ধনাট্য মহিলা। আরবের কোন ধনাট্য ব্যক্তির সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে দরিদ্র মুহম্মদ (সা.)-এর সাথে তাঁর বিবাহ হলে কুরাইশরা তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। এতে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হন। এই সময় তিনি মক্কার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তাঁর বাড়িতে দাওয়াত করেন। মেহমানদারি করার পর তিনি তাদের বলেন, আপনারা সকলে অবগত আছেন যে, আমি একজন নিঃস্ব ব্যক্তির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এ কারণে আপনাদের অনেকে আমাকে নিন্দা করেছেন। এর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমি আজ আপনাদের আমার বাড়িতে সমবেত করেছি। আপনারা সাক্ষী থাকুন, আজ থেকে আমি আমার সব সম্পত্তি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে এবং কারো বিনা প্রলোভনে আমার স্বামীকে দান করলাম। তিনি এখন থেকে আমার সম্পদের মালিক। এতে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ লজ্জিত হলো। তারা আর কখনও ঐরূপ কথা মুখে আনেনি। রাসূল (সা.) খাদিজা (রা.)-এর দেয়া সব সম্পত্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করেন।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)
হযরত আয়েশা (রা.) বিনতে আবু বকরের লকব ছিল সিদ্দিকাহ ও হোমায়রা। তাঁর মা ছিলেন উম্মে রুম্মান (রা.) বিনতে আমের। হিজরতের তিন বছর আগে শওয়াল মাসে ৬ বছর বয়সে রাসূল (সা.)-এর সাথে হযরত আয়েশার (রা.) বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। হযরত আবু বকর (রা.) স্বয়ং বিয়ে পড়ালেন। পাঁচশ’ দিরহামে মোহর নির্ধারিত হলো।
হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন হাদিস শাস্ত্রের এক বিরাট জ্ঞানের আধার। তাঁর প্রায় দুশ’ শিষ্য ছিল। এ সব শিষ্যদের মধ্যে কাসিম বিন মুহম্মদ (রা.), মাসরুক তাবেয়ী রা.), আয়েশা বিনতে তালহা (রা.), আবু সালমা (রা.) এবং উরওয়াহ বিন যোবায়েরের (রা.) নাম প্রসিদ্ধ।
নৈতিক মর্যাদার দিক থেকে হযরত আয়েশার (রা.) স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি অসীম দানশীল, অতিথিপরায়ন, এবং দরিদ্র সেবী ছিলেন। এশবার হযরত আবদুল্লাহ বির যোবায়ের (রা.) তাঁকে একলাখ দিরহাম প্রেরণ করলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তা গরীব মিসকিনদের মধ্যেব ন্টন করে দিলেন। হযরত উরওয়াহ বিন যোবায়ের বলেন, একবার হযরত আয়েশার (রা.) নিকট ৭০ হাজার পরিমাণ দেরহাম এল। তিনি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা খোদার রাস্তায় বিলিয়ে দিলেন এবং দোপাট্টার আঁচল ঝেড়ে নিলেন।
ইমাম মালিকের মুয়াত্তায় আছে, হযরত আয়েশা (রা.) একদিন রোযা ছিলেন এবং গৃহে একটি রুটি ছাড়া কিছুই ছিল না। ইতিমধ্যে একজন ভিখারিনী এসে হাঁক দিল। তিনি দাসীকে সেই রুটি ভিখারিনীকে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। দাসী বললো, সন্ধ্যায় ইফতার কি দিয়ে করবেন? উম্মুল মুমিনিন বললেন, রুটিতো দিয়ে দাও। সন্ধ্যা হলো। এ সময় এক ব্যক্তি হাদিয়া হিসেবে বকরীর গোশত পাঠালেন। তিনি দাসীকে বললেন, দেখ আল্লাহ রুটির চেয়ে উত্তম জিনিস পাঠিয়েছেন।
উম্মুল মুমিনিনের (রা.) বদান্যতার কোন পরিসীমা ছিল না।খালার অসমান্য বদান্যতা দেখে হযরত আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের একবার বলে ফেললেন যে, এখন থেকে তিনি আর কিছু দেবন না। এ কথা শুনতে পেয়ে হযরত আয়েশা খুব কষ্ট পেলেন এবং কসম খেলেন যে তিনি যোবায়েরে সাথে কথা বলবেন না। এ কথা শুনে হযরত যোবায়ের (রা.) খুব ঘাবড়ে গেলেন এবং দুজন সাহবীর মাধ্যমে খালার রাগ ভাঙ্গালেন। হযরত আয়েশা (রা.) তাঁর কসম ভাঙ্গলেন এবং কাফফারা হিসেবে ৮০ জন গোলাম আজাদ করেন। আল্লহর পথে দানে এ অগ্রগামী উম্মুল মুমিনিন ৫৮ হিজরীতে রমযান মাসে ৬৭ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
হযরত মাইমুনা বিনতে হারিছ
উম্মুল মুমিনিন হযরত মাইমুনা বিনতে হারিছ ( রা.)-এর প্রকৃত নাম ছিল বাররাহ। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বিবাহের পর তাঁর নাম রাখা হয় মাইমুনা। হযরত মাইমুনা (রা.)অত্যন্ত মুত্তাকী এবং খোদারপ্রতি ভয় পোষণকারী মানুষ ছিলেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “মাইমুনা (রা.) আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদার প্রতি ভয় পোষণকারী এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী ছিলেন। একবার তিনি একজন বাদীকে খোদার রাস্তায় স্বাধীন করেদিলেন। হুজুর (সা.) জানতে পেরে বললেন, “খোদা তোমাকে সওয়াব দিন।”
হজরত মাইমুনা (রা.) অত্যন্ত কল্যাণকামী এবং দানশীলা ছিলেন। এই দারাজ দিলের কারণে মাঝে মধ্যে ঋণও গ্রহণ করতে হতো। একবার বিরাট অংকের ঋণ নিয়ে ফেললেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, “উম্মুল মুমিনিন! এতবড় অংক পরিশোধের ব্যবস্থা কি হবে?” তিনি বললেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে শুনেছি, যে ব্যক্তি ঋণ আদায় করার নিয়ত রাখে আল্লাহ স্বয়ং তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন।” হযরত মাইমুনা বিনতে হারিছ (রা.) থেকে ৪৬টি মতান্তরে ৭৬টি হাদিস বর্ণিত আছে। মাইমুনা (রা.) ৫১ হিজরীতে ছারফে ইন্তিকাল করেন।
হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)
যয়নব বিনতে জাহাশ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো বোন। ইসলামের দিক থেকে তিনি সাবেকুনে আউয়ালুনদের পর্যায়ভুক্ত। ইবনে কাসীর লিখেছেন যে, অন্যান্য স্ত্রীর তুলনায় হযরত যয়নব তাঁর বিবাহের জন্য গর্ব করতেন এই বলে যে, আল্লাহ তায়ালা আসমানে আমার আকদ সম্পন্ন করেছেন। আর আমার বিয়েতেই নবীজী গোশত-রুটি দ্বারা ওলীমার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি ছিলেন, অত্যন্ত দানশীলা। হাফেয ইবনে হাজার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল এসাবায় লিখেছেন, ইফকের ঘটনায় হযরত যয়নব হযরত আয়েশার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার, দরাজ হস্ত, দানশীলা আল্লাহর উপর নির্ভর শীলা এবং আল্পেতুষ্ট। এতিম, মিসকীন এর অভিভাবক এবং ফকীরদের সহায়।
ইবসেন সা’আদ বলেন, যয়নব বিনতে জাহাশ দীনার -দিরহাম কিছুই রেখে যাননি। যা কিছু সম্ভব, ছদকা করে দেন। তিনি ছিলেন মিসকীন তথা নিঃস্ব জনের আশ্রয় স্থল। মুসা ইবন তারেক তাঁর রেওয়ায়েতে বলেন যে, হযরত আয়েশা জয়নবের প্রশংসা করে বলেন, দ্বীনদারী, তাকওয়া, সত্যবাদীতা, আত্মীয় স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি, দানশীলতা এবং আত্মত্যাগে তাঁর চেয়ে উত্তম মহিলা আর কেউ ছিল না। হযরত যয়নবের মৃত্যুতে হযরত আয়েশা সব চাইতে বেশি শোকাহত হন। হযরত যয়নবের ইন্তিকালে তিনি বলেন, ভাগ্যবতী অনন্যা মহিলা বিদায় নিয়েছেন। এতিমরা হয়ে পড়েছে অস্থির ব্যাকুল তিনি ছিলেন এতিমদের আশ্রয় স্থল।
ওফাতের পূর্বে নবীজী স্ত্রীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তোমাদের মধে যার হাত সব চাইতে দরাজ, সে সকলের আগে আমার সাথে মিলিত হবে। হাত দরাজের অর্থ দানশীলতা। বিবিগণ এর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করেন। সকলে একত্র হলে একে অন্যের হাত মাপতেন। হযরত যয়নবের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এমনটি চলে। এর পর তারা নবীজীর কথার আসল অর্থ বুঝতে সক্ষম হন। তাই হযরত আয়েশা এ হাদিসের ব্যখ্যায় বলেন, আমাদের মধ্যে হযরত যয়নব ছিলেন সব চেয়ে দরাজ হাত। কারণ তিনি নিজ হাতের উপার্জন থেকে সদকা করতেন।
আবুদ্দাহ আনসারী ও তাঁর স্ত্রী
তখন ইসলামের প্রথম যুগ। ইসলামকে মিটিয়ে দেখার জন কুফরী শক্তি উঠে পড়ে লেগেছে। কাফেরদের মোকাবিলা করার জন্য প্রচুর টাকা কড়ির প্রয়োজন। এমন সময় নাজিল হলো, “এমন কে আছে যে আল্লাহ তায়ালাকে ঋণ দেবে, উত্তম ঋণ? যেন আল্লাহ তা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে ফিরিয়ে দিতে পারেন এবং তার জন্য অতীব উত্তম সওয়াব রয়েছে।”
রাসূল (সা.)- এর পাক জবাণীতে এ কথা শুনে সাহাবীগণ অস্থির হয়ে উঠলেন আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে। এগিয়ে এলেন হযরত আবুদ্ দাহ আনসারী। খুশিতে অন্তর তাঁর ভরপুর। চেহেরায় ফুটে উঠেছে বেহেশতী আভা। আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি জানতে চাইলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা কি আমাদের কাছে ঋণ চান?” জওয়াবে হুজুর (সা.) বললেন, “হে আবুদ্ দাহ, হ্যাঁ, তিনি ঋণ চান ?”
আবুদ্ দাহদাহার প্রাণে জেগে উঠল আল্লাহর মহব্বতের জোশ। তিনি বললেন, “হুজুর আপনি আপনার মোবারক হাতখানা আমাকে একটু দেখানতো। রাসূল (সা.) তার দস্ত মোবারক এগিয়ে দিলেন আবুদ্ দাহদার দিকে। তিনি রাসূলের হাতখানি নিজের হাতের মুঠোয় ভক্তি বিহবল হৃদয়ে পুরে নিলেন এবং বললেন, “আমি আমার বাগান খানা আমার খোদাকে ঋণ দিলাম।” এ বাগানখানা সাধারণ বাগান ছিল না। সেখানে ছিল ছয়শত খেজুর গাছ। এসব গাছের ছায়ায় ছিল তাঁদের থাকার ঘর।
এখানে বাস করতেন আবুদ্ দাহদাহ তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে। আবুদ্ দাহ রাসূলকে খেজুর বাগান দিয়ে আর দেরি করলেন না, সোজাসুজি চলে এলেন বাড়িতে। অত্যন্ত আনন্দের সাথে ডাক দিলেন স্ত্রীকে, বললেন, “দাহদার মা, ঘর থেকে বেরিয়ে এস। এ বাগান খানা আমি আমার খোদাকে ঋণ দিয়ে এসেছি।” স্ত্রী এ কথা শুনে অত্যন্ত খুশি। তিনি বললেন, “হে দাহদার বাপ, তুমি তো এ কাজ করে এক বিরাট লাভের কারবার করে ফেলেছ।” তাঁর চোখে মুখে বেহেশতী আভা। এতটুকু চিন্তা নেই, ছেলে মেয়েদের হাত ধরে এখনই বাড়ি পেছনে ফেলে চলে যেতে হবে। তাঁদের দাঁড়াতে হবে সুনীল আকাশের ছায়ায় আজানা জায়গায়। তিনি প্রিয় স্বামীর আহ্বানে আর দেরি না করে সমস্ত মালামাল নিয়ে-ছেলে মেয়েদের হাত ধরে খুশিতে খুশিতে বের হয়ে এলেন বাগান বাড়ি থেকে। পেছনে রেখে এলেন বিরাট বাগান বাড়ি, বহু স্মৃতি মাখা ঘরখানা। আল্লাহ জান্নাতে এর চেয়ে অধিক মূল্যবান ঘর দেবেন এ আশায়।
হযরত ফাতেমাতুজ জোহরা (রা.)
সাইয়েদা ফাতেমাতুজ জোহরা (রা.) ছিলেন রাসূল করীম সা.)-এর চতুর্থ এবং সর্বকনিষ্ঠ কন্যা। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলে অত্যন্ত গভীর ও আত্ম প্রকাশ ও প্রদর্শনীতে ছিল তাঁর প্রচ- অনীহা। একবার খাদিজাতুল কোবরা তাঁর এক আত্মীয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে যাবার জন্য ফাতেমার জন্য ভাল কাপড় ও গহনা বানালেন। বিয়েতে যোগদানের জন্য যখন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হলো তখন হযরত ফাতেমা এসব কাপড় ও গহনা পরতে অস্বীকার করলেন এবং সাদাসিধেভাবেই বিয়ের মাহফিলে অংশ নিলেন।
মদীনায় হিজরতের সময় সাইয়েদা ফাতেমাতু জোহরা (রা.) বয়োপ্রাপ্তা হলেন। হুজুর (সা.) তার বিবাহ হযরত আলী (রা.)-এর সঙ্গে স্থাপন করলেন। হুজুর (সা.)বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন এবং মুচকি হেসে আলী মুরতাজাকে বললেন, “আমি চারশ’ মিসকাল রৌপ্য মোহরের বিনিময়ে ফাতেমাকে তোমার নঙ্গে বিবাহ দিলাম। তুমি কি তা কবুল করেছে? হযরত আলী (রা.)বললেন, “জ্বী, কবুল করলাম।” অতঃপর হুজুর দোয়া করলেন। সকলেই দোয়ায় শরীক হলেন। হযরত ফাতেমা ও অলীর সংসার ছিল অত্যন্ত গরিবী হালের। একবার রাসূল (সা.)হযরত ফাতেমাতুজ জোহরার ঘরে গিয়ে দেখলেন যে, স্নেহেন কন্যা উটের চামড়ার পোশাক পরে আছেন এবং তাতেও ১৩টি পট্টি মারা। তিনি আটা পিষছেন এবং মুখ দিয়ে আল্লাহর কালাম উচ্চারণ করছেন।
এত গরিবী হালে থাকার পরেও তিনি যথাসাধ্য আল্লাহর রাহে দানে পিছিয়ে ছিলেন না।একবার সালমান ফারসী একবৃদ্ধ আরাবীকে সঙ্গে নিয়ে হযরত ফাতেমাতুজ জোহরার বাড়িতে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন এবং বললেন, হে আল্লাহর সত্য রাসুল (সা.)কন্যা! এই মিসকিনের খাবারের বন্দোবস্ত করুন।”
হযরত ফাতেমা (রা.) বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “হে সালমান! খোদার কসম!আজ আমরা তৃতীয় দিনের মতো অভুক্ত রয়েছি। শিশু দুটি অভুক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। কিন্তু সায়েলকে খালিহাতে ফিরে যেতে দেব না। আমার এই চাদর শামউন ইহুদীর কাছে নিয়ে যাও এবং বলো ফাতেমা (রা.) বিনতে মুহম্মদের (সা.) এই চাদর রেখে গরীব মানুষটিকে কিছু দাও।” সালমান (রা.) ইহুদীর নিকট গেলেন এবং সব কিছু খুলে বললেন। সব শুনে ইহুদী সালমানকে বললেন, “তুমি সাক্ষী থেক যে, আমি ফাতেমার (রা.) পিতার (সা.) ওপর ঈমান এনেছি।”এর পর কিছু খাদ্য হযরত সালমান (রা.) কে দিলেন এবং চাদর খানাও সাইয়েদা ফাতেমাকে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তা নিয়ে তাঁর নিকট পৌঁছলেন। সাইয়েদা ফাতেমা (রা.) স্বহস্তে তাড়াতাড়ি আরাবীর জন্য রুটি বানায়ে সালমানকে দিলেন। তিনি বললেন, “এ থেকে বাচ্চাদের জন্য কিছু রেখে দিন।” হযরত ফাতেমা (রা.) জওয়াব দিলেন, “সালমান!যা খোদার রাস্তায় দিয়েছি, তা আমার বাচ্চাদের জন্য জায়েজ নয়।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার হযরত আলী (রা.) সারা রাত ধরে এক বাগানে সেচ দিলেন এবং মজুরী হিসেবে সামান্য যব পেলেন। হযরত ফাতেমা (রা.) তা থেকে এক অংশ নিয়ে আটা পিষলেন এবং খাবার তৈরি করলেন। ঠিক খাবার সময় এক মিসকিন দরজায় কড়া নাড়লো এবং বললো, “আমি ভুখা আছি।” হযরত সাইয়েদা (রা.) সম্পূর্ণ খাবার তাকে দিয়ে দিলেন। অতঃপর অবশিষ্ট আনাজের কিছু অংশ নিয়ে পিষলেন এবং খাবার তৈরি করলেন। খানা তৈরি শেষ হতেই একজন দরজায় এসে হাত পাতলো। তিনি সব খাবার তাকে দিয়ে দিলেন। অতঃপর আবশিষ্ট আনাজ পিষলেন এবং খাবার তৈরি করলেন। ইতিমধ্যে এক জন মুশরিক কয়েদী আল্লাহর রাস্তায় খাবার চাইলো। সেই সকল খাবার তাকে দিয়ে দেয়া হল। ফলে বাড়ির সবাই সেদিন অভুক্ত রইলেন। আল্লাহ পাক তাদের এ দানকে এমন পছন্দ করলেন যে, তাদের সবার জন্য আয়াত নাজিল হলো। “ওয়া ইউত্য়েমুনাত্ তায়ামা আলা হুব্বিহি মিসকিনাওঁ ওয়া ইয়াতিমাও ওয়া আছিরা”-এবং সে আল্লাহর রাস্তায় মিসকিন, এতিম ও কয়েদীকে খাবার খাওয়ায়। এ ভাবে রাসূল দুহিতা হযরত ফাতেমা (রা.) সর্বকালের মহিলাদের জন্য দানের আদর্শ নমুনা রেখে গেলেন।
হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রা.)
হিজরতের ২৭ বছর পূর্বে হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রা.) মক্কা মুয়াজ্জামাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এসময় মাত্র ১৭ জন পবিত্র আত্মার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেÑ আস্সাবেকুনাল আউয়ালুনের কাতারে তিনি ছিলেন ১৮তম ব্যক্তিত্ব। হযরত আসমার বিয়ে হয়েছিল হযরত যোবায়ের (রা.)বিনুল আওয়ামের সাথে। তিনি ছিলে আসহাবে অশারায়ে মুবাশশিরার অন্যতম।
প্রথমদিকে দারিদ্রতার কারণে হযরত আসমা (রা.) প্রত্যেকটা জিনিসই মেপে জুখে খরচ করতেন। রাসূল (সা.) এ কথা জানতে পেরে হযরত আসমাকে বললেন, “আসমা! মেপে জুখে খরচ কর না। তা হলে আল্লাহও মেপে জুখে রুজী দেবেন।” হযরত আসমা হুজুরের ইরশাদকে জীবনের মূলমন্ত্র বানিয়ে নিলেন এবং উদারহস্তে খরচ করতে লাগলেন। খোদার কুদরতে সেই সময় থেকে হযরত যোবায়েরের (রা.) আয় বৃদ্ধি পেতে থাকলো এবং কিছু দিনের মধেই তাঁর গৃহে সম্পদের ছড়াছড়ি হয়ে গেল। হযরত আসমা ধন-সম্পদ দান খয়রাতের ব্যাপারে অবারিত ভাবে খরচ করতেন। যখনই কোন অসুস্থতায় পড়তেন তখনই কোন গোলাম আযাদ করে দিতেন। সন্তানদের সবসময় হেদায়াত করতেন যে, সম্পদ জমা করার বস্তু নয়। বরং অভাব গ্রস্তদের সাহায্য করার জন্যই তা দেয়া হয়। যদি তোমরা বখিলী কর তাহলে আল্লাহও তোমাদের তার ফজল থেকে মাহরুম রাখবেন। হ্যাঁ, যা সদকা করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে তা তোমাদের কাজে আসবে। ইে সঞ্চয় নষ্ট হওয়ার কোন আশংকা নেই।
হযরত আবদুল্লাহ বিন যোবায়েরের (রা.) মতে, তিনি তাঁর মায়ের চেয়ে বেশি দানশীর মানুষ দেখেননি। অন্য এক রেওয়ায়েতে তিনি বলেছেন, খালা আয়েশা (রা.) এবং মা আসমা (রা.) থেকে বেশি দানশীল এবং শরীফ ব্যক্তি আর দেখেননি। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, হযরত আয়েশা (রা.) অল্প অল্প করে জমা করে যা হতো তা আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতেন। অন্য দিকে হযরত আসমা (রা.) যখন যা পেতেন তখনই তা বণ্টন করে দিতেন একবার রহমতে আলম (সাঃ) মুসলমানদের আল্লাহর পথে বেশি বেশি সম্পদ সাদকাহ করার নির্দেশ দিলেন। সকল সাহাবা (রা.) প্রতিযোগিতামূলকভাবে নবী সা.)-এর নির্দেশ পালন করলেন। মহিলা সাহাবীরা শরীরের গহনা খুলে দিলেন। হযরত আসমার (রা.) নিকট একটি দাসী ছিল। তিনি তা বিক্রি করে অর্র্থ নিয়ে বসে গেলেন। হযরত যোবায়ের (রা.) গৃহে ফিরে হযরত আসমার (রা.) নিকট অর্থ চাইলেন। তিনি বললেন, “আমি সাদকাহ করে দিয়েছি।” হযরত যোবায়ের (রা.) চুপ হয়েগেলেন। কেননা তিনিও আল্লাহ এবং রাসূলের (সাঃ) সন্তুষ্টি কামনা করতেন।
হযরত আসমা ইলম ও ফজিলতের দিক দিয়ে অত্যন্ত উঁচু স্থানে সমাসীন ছিলেন। তাঁর থেকে ৫৬টি হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি ইসলামের ইতিহাসে একজন মহান ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর কর্মময় জীবন মুসলমানদের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া মহিলা সাহবীগণ ধন-সম্পদ; এমনকি তাদের গহণাপত্র আল্লাহর রাহে দান করতে ছিলেন দরাজ দিল। জাবের (রা.) বলেন যে, আমি বহুবার আল্লাহর নবীর সঙ্গে দুই ঈদের নামায পড়েছি। আমি হুজুরকে দেখেছি- তিনি প্রথমে নামায আদায় করতেন অতঃপর তিনি মহিলা মহলের নিকটবর্তী হতেন এবং তাদের বহুমুখী উপদেশ দিতেন এবং দান খয়রাত করার জন্য তাদের উৎসাহিত করতেন। (মিশকাত)। মহিলাগণ আল্লাহর নবীর নিকট দান খয়রাতের কথা শুনে গলার হার, কানের দুল হাতের চুড়ি, বিভিন্ন অলংকার বেলালের কাপড়ে নিক্ষেপ করতেন। (মুসলিম, তিরমিযি)
অন্য আরেকটি হাদিস- আল্লাহর নবী ঈদের নামায পাঠের জন্য দন্ডায়মান হলেন। তিনি নামাযান্তে খুতবা পাঠ করলেন এবং মেয়েদের কাছে এসে ওয়াজ শুনালেন। বেলাল একখানা লম্বা কাপড় ধরেছিলেন। তাতে মেয়েরা অনেক টাকা পয়সা, গলার হার এবং কানের দুল প্রদান করেছিলেন এবং জীবনের সদকা দিয়েছিলেন। (বোখারী)
সম্রাজ্ঞী জুবাইদা
আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশীদের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী জুবাইদা। জনসাধারণের সুবিধার্থে খলিফা সাম্রাজ্যের সর্বত্র স্কুল কলেজ, মাদরাসা মসজিদ ঈত্যাদি নির্মাণ করেন। সম্রাজ্ঞী জুবাইদা হজব্রত পালনকালে হজ্বযাত্রীদের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য ১৭৪ হিজরীতে একটি খাল খনন করেন। নহরই জুবাইদা নামে এ খালটি অদ্যাকধি তাঁর স্মৃতি বহন করছে। এর উৎপত্তিস্থল ছিল পাবিত্র কাবা গৃহ থেকে ৩৬ কিঃমিঃ দূরে নুমান উপত্যকা থেকে। তায়েফ আল হুদার রাস্তার পাশ দিয়ে এটি প্রবাহিত ছিল। আরাফাত, মুযদালিফা ও মিনার পাশ ঘিরে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে নহরটি মক্কায় শেষ হয়। প্রায় বারশত বছর ধরে এর পানি মক্কাবাসীদের সেচকার্যে ব্যহৃত হয়ে আসছিল। পরবর্তীতে নহরটি পরিত্যক্ত হয় এবং নহরের স্থলে বিরাট আকারের পাইপলাইন বসানো হয়। ১৪২১ হিজরীতে কিং আবদুল্লাহ বিন আব্দুল আযিয এর পানি ব্যবহার করা যায় কিনা, তা নিরূপনের ওপর বেশ গুরুত্ব প্রদান করেন। সম্রাজ্ঞী জুবাইদা যে জনহিতকর কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন তা নিশ্চয়ই একটি মহৎ কাজ ছিল সন্দেহ নেই। এ কারণে এতকাল পরও বিশ্বের মুনলমানরা শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করছে। এভাবে বিভিন্নকালে বিভিন্ন নারী আল্লাহর পথে দান করে যে আদর্শ রেখে গেছেন, তা আমাদের অনুসরণের প্রচেষ্টা চালানো উচিত।