সব প্রস্তুতি সম্পন্ন : উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার তিন সিটি নির্বাচন আজ
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার তিন সিটি নির্বাচন আজ মঙ্গলবার। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলবে। ভোটগ্রহণের যাবতীয় প্রস্তুতি এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছেছে ব্যালট পেপার ও বাক্সসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জমাদি।
সবকিছু ঠিক থাকলে আজই জানা যাবে কারা হচ্ছেন এক ঢাকায় দুই নগরপিতা। পাশাপাশি দেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নগরী চট্টগ্রামেও কে পাচ্ছেন এ গুরু দায়িত্ব তাও জানা যাবে।
তবে ফলাফল যাই হোক তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা নিয়ে দেশের দুই প্রধান দল ও জোটের নেতাকর্মীদের মাঝে উত্তেজনার পারদ যে সর্বদা তুঙ্গে ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে গিয়ে পর পর তিনদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নজিরবিহীন হামলার শিকার হন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে।
তবে ভাগ্যগুণে তিনি হামলাকারীদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও এ নিয়ে দেশ ও বিদেশে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে সেটাও মনে হয় কোন পৃথিবী ইতিহাসে কোন সভ্য সমাজে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।
খোদ তিন তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর ওই হামলার পর থেকে নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে হবে কি না এ নিয়ে সর্বত্র আজ সন্দেহ-সংশয়।
ফলে উৎসাহ-উদ্দীপনার ভোট হলো আজ দেশবাসীর কাছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর সন্দেহ-সংশয়ের প্রতীক।
তাছাড়া জাতীয় নির্বাচন না হলেও এ নির্বাচনে জয়-পরাজয় দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্যই যে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের কাছে এ নির্বাচনে জয়টা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাসীন দলের কছে। হারলে ক্ষমতাসীন দলের জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকা আগের চেয়ে আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে।
তাই তো যে করেই হোক তিন সিটি নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে রাখতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার শুরু থেকেই মরিয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
ক্ষমতাসীনদের এ আচরণের কারণে নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হওয়া নিয়ে এরই মাঝে দেশী-বিদেশী নানা মহল থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ইসির কাছে সেনা মোতায়েনের দাবি জানানো হয়েছি।
এ দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ইসি শুরুতে সেনা মোতায়েনের জন্য সিদ্ধান্ত দিলেও পরে তা থেকে সরে আশায় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হওয়া নিয়ে জনমোনে সন্দেহ-সংশয় বহু গুণে বেড়ে যায়।
সবশেষে সোমবারও শেষ বারের মতো ইসিকে সেনা মোতায়েনের অনুরোধ করে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা। কিন্তু তাতে কোন কর্ণপাত করেনি নির্বাচন কমিশন।
এর আগে কয়েক দফা তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর পর সবশেষ সোমবার বিকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবার স্পস্ট করেই জানিয়ে দেন র্যাব-পুলিশ ব্যর্থ হলে এবং রিটার্নিং কমকর্তা ডাকলে তবেই সেনা মোতায়েন।
তবে এ ঘোষণার পাশপাশি ভোটগ্রহণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনোরকম শৈথিল্য নির্বাচন কমিশন বরদাস্ত করবে না বলেও তিনি ঘোষণা করেন।
ফলে নিছক লোক দেখানো ছাড়া নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের আর কোন লক্ষণই না থাকায় চোখেমুখে উদ্বেগ-আতঙ্ক নিয়েই ভোট কেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যেতে হচ্ছে প্রার্থীদের। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার সোমবার বিকালে সবশেষ ব্রিফিংয়ে ভোটারদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন।
এতে তিনি ভোটারদের শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তিন সিটির নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের কোনোরকম শৈথিল্য নির্বাচন কমিশন বরদাস্ত করা হবে না।
তিন সিটি নির্বাচনে সার্বিক প্রস্তুতি ব্যাখ্যা করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
তিনি বলেন, সকল ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং নির্বাচন পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট সকলকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিচ্ছি। এর ব্যত্যয় হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ ও চট্টগ্রামের ভোটারদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, আপনারা নিরাপদে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাসায় ফেরত যাবেন। নির্বাচনে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান সিইসি।
তিনি বলেন, নির্বাচনে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৮০ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হবে। এর মধ্যে থাকবে ১০০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ভোটের দিন কেন্দ্রের ভেতরে সশস্ত্র অবস্থায় ১০ জনসহ ২২ জন সার্বক্ষণিক অবস্থান করবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে ১২ জন সশস্ত্র সদস্যসহ ২২ জন দায়িত্ব পালন করবেন।
এছাড়া ভোটকেন্দ্রের বাইরে প্রতিটি ওয়ার্ডে পুলিশ ও র্যাবের ২টি করে মোবাইল টিম সার্বক্ষণিক টহল দেবে। পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের পরও জনগণের স্বস্তির জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তও নিয়েছে ইসি। তারা ঢাকার তিনটি ও চট্টগ্রামের দু’টি জায়গায় অবস্থান করবে। এছাড়া থাকবে ১৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি আরো বলেন, র্যাব-পুলিশ ব্যর্থ হলেই রিটার্নিং কর্মকর্তার ডাকের সঙ্গে সঙ্গেই সেনা মোতায়েন করা হবে। দেশীয় পর্যবেক্ষকের পাশাপাশি শতাধিক বিদেশী পর্যবেক্ষকও থাকবেন বলে তিনি জানান।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে এবার মোট ৬০ লাখ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। ভোট প্রদানের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে না। শুধু সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ভোটার নাম্বার নিয়ে উপস্থিত হলেই ভোট দেয়া যাবে।
ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনজন রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ প্রায় ৪৯ হাজার ৩৮১ জন কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবে। এর মধ্যে ৪৫ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকতা ও দুই হাজার ৭০১ জন প্রিজাইডিং অফিসার এবং ৪৬ হাজার ৬৩২ জন অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন : ঢাকা উত্তরে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২টি ও সাধারণ ৩৬টি। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ৯৩টি ও ভোট কক্ষের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৮৯২টি। মোট ভোটার সংখ্যা ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১২ লাখ ২৪ হাজার ৭০১ জন ও মহিলা ভোটার ১১ লাখ ২০ হাজার ৬৭৩ জন ।
এই সিটিতে মেয়র পদে ১৬ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর ৮৯ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৮১ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতা করবেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকবে একজন ঢাকা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহ আলম ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আছে ১২ জন।
ঢাকা উত্তরে প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন এক হাজার ৯৩ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার থাকবে ৫ হাজার ৮৯২ জন। পোলিং অফিসারের সংখ্যা ১১ হাজার ৭৮৪ জন। মোট ১৮ হাজার ৭৬৯ জন কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন : ঢাকা দক্ষিণের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সংখ্যা ১৯টি ও সাধারণ ৫৭টি। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৮৮৯টি ও ভোট কক্ষের সংখ্যা ৪ হাজার ৭৪৬টি। মোট ভোটার সংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৩ জন। এর মধ্যে মহিলা ভোটার ৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৬৭ জন ও পুরুষ ভোটার ১০ লাখ ৯ হাজার ২৮৬ জন।
এই সিটিতে মেয়র পদে ২০ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর ৯৭ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩৯০ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতা করবেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকবে একজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আছে ১৯ জন।
ঢাকা দক্ষিণে প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন ৮৮৯ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার থাকবে ৪ হাজার ৭৪৬ জন। পোলিং অফিসারের সংখ্যা ৯ হাজার ৪৯২ জন। মোট ১৫ হাজার ১২৭ জন কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন।
চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন : চট্টগ্রাম সিটিতে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সংখ্যা ১৪টি ও সাধারণ ৪১টি। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৭১৯টি ও ভোট কক্ষের সংখ্যা ৪ হাজার ৯০৬টি। মোট ভোটার সংখ্যা ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯ জন। এর মধ্যে মহিলা ভোটার ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৩৯৬ জন ও পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৫৩ জন।
এই সিটিতে মেয়র পদে ১২ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর ৬২ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২১৩ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতা করবেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকবে একজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল বাতেন, ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আছে ১৪ জন।
চট্টগ্রামে প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন ৭১৯ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার থাকবে ৪ হাজার ৯০৬ জন। পোলিং অফিসারের সংখ্যা নয় হাজার ৮১২ জন। মোট ১৫ হাজার ৪৩৭ জন কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন।