কাটা পড়ছে ৪০ একর বন
কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুলে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি ব্যাটালিয়ন স্থাপন করা হচ্ছে। এর নাম রামু ব্যাটালিয়ন। এর জন্য ৪০ একর বন কাটা পড়ছে। এর মধ্যে ৩৬ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কাটা হয়েছে দুটি বড় পাহাড়ও।বন আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনে ঢুকতে বন বিভাগের অনুমতি লাগে; আর গাছ কাটতে অনুমতি লাগে প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু ৩৬ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করা হলেও তার জন্য যথাযথ অনুমতি নেয়নি বিজিবি।বিজিবি জানিয়েছে, রাষ্ট্রের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ও চোরাচালান প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করতে এই জায়গায় ব্যাটালিয়ন স্থাপন করা হচ্ছে।কক্সবাজারের রামু উপজেলা সদর থেকে মিয়ানমার সীমান্তের দিকে চার কিলোমিটার এগোলেই রাজারকুল সংরক্ষিত বনভূমি। এটি মূলত হাতির বিচরণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তবে সংরক্ষিত হলেও এই বনে গাছের চেয়ে লতাগুল্মই বেশি।বন বিভাগ ও স্থানীয় অধিবাসীদের সূত্রে জানা গেছে, রাজারকুল বনে একপাল হাতি নিয়মিত বিচরণ করে। প্রতিবছর জুন-জুলাইয়ের দিকে হাতির পালটি রাজারকুলে অবস্থান করে। কিন্তু এ বছর বনের একটি অংশ কেটে ফেলায় হাতির দল আর আসেনি বলে মনে করেন স্থানীয় লোকজন। বন বিভাগের সূত্র জানায়, ওই বনে হাতি, হরিণ, সাপ, কাঠবিড়ালি, বনখাটাশ, খরগোশ, খ্যাঁকশিয়াল, বনমোরগের বসতি ছিল। গাছপালার মধ্যে ছিল গর্জন, শাল, ঢাকিজাম, আরশোল, বর্তা, উরিআম, বাটনা ও নানা প্রজাতির লতাগুল্ম। এই জায়গায় জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে বন বিভাগ থেকে একটি উদ্ভিদ উদ্যান স্থাপন করা হয়েছে। আর বিজিবি লাল পতাকা পুঁতে যে ৪০ একর জায়গা নিজেদের জন্য চিহ্নিত করেছে, সেই জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তন সহায়ক তহবিলের (বিসিসিআরএফ) টাকায় ৩৭ হাজার ৫০০ গাছ লাগানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। গত ২৬ জুলাই রাজারকুল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ভূমি সমান করা ও বৃক্ষরাজি কাটার বড় বড় যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। মাটি সমান করার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা জানান, তিন মাস ধরে তাঁরা সেখানে কাজ করছেন। সেখানে খড়ের ছাউনি দিয়ে বিজিবি একটি অস্থায়ী কার্যালয়ের মতো করেছে। তবে বিজিবির ‘নেওয়া’ অংশের বাইরে বনের অন্য অংশের চিত্রও খুব একটা ভালো নয়। সংরক্ষিত বন হলেও এর ভেতরে দোকানপাট ও বাড়িঘর দেখা গেছে। এক পাশে বন কেটে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ফলের বাগানও করেছেন।
বন আইন ১৯৯৪ অনুযায়ী, সংরক্ষিত বন অন্য কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা খোদ বন বিভাগের নেই। এ ধরনের বনে প্রবেশ করতে হলে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বন কাটতে হলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন লাগে। বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নজরুল ইসলাম বলেন, ওই এলাকাকে কাগজে-কলমে সংরক্ষিত বন বলা হলেও সেখানে কোনো বন ছিল না। বন বিভাগ নিজেই ওই বনের মধ্যে উদ্ভিদ উদ্যানসহ নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে তুলেছে। অনেক অবৈধ দখলদারও ওই বনের মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সীমান্ত রক্ষার জন্য ব্যাটালিয়ন স্থাপনের অনুমতি চেয়েছি। বন বিভাগ থেকে তার বিরোধিতা করা হচ্ছে।’ জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমরা সংরক্ষিত বনের একটি অংশ বিজিবিকে ব্যাটালিয়ন স্থাপনের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছি। তবে বনের কতটুকু অংশ তাদের দেওয়া যাবে, সে বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখার জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।’ গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর বিজিবি এক চিঠিতে রামু এলাকায় একটি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জমি বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদন চায়। চিঠিতে কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুলের ওই ৪০ একর সংরক্ষিত বনকে পাহাড়ি খাসজমি উল্লেখ করে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত চাওয়া হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সীমান্ত অধিশাখা-১ ওই জমি বিজিবিকে বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। অবশ্য এই চিঠিতে রাজারকুলের ওই জমিকে সংরক্ষিত এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয় বন্দোবস্তের বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের মতামত চায়। জেলা প্রশাসক একে সংরক্ষিত বন উল্লেখ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়।
গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিজিবি ৩১ ব্যাটালিয়ন নাইক্ষ্যংছড়ির অধিনায়ক ওই জমি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগকে মৌখিকভাবে বলেন। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বিপুল কৃষ্ণ দাস লিখিতভাবে ৩১ ব্যাটালিয়নকে জানান, বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষমতা বন বিভাগের নেই। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তা দিতে পারেন। কিন্তু মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিজিবি রাজারকুলের বন কাটা শুরু করে। বন কাটার খবর পাওয়ার পর গত ১৬ মে প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী বিজিবির মহাপরিচালককে চিঠি দেন। তাতে বলা হয়, সংরক্ষিত ও রক্ষিত বন হওয়ায় তা বন্দোবস্তযোগ্য নয়। অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ারও বন বিভাগের নেই। যথাযথ সরকারি অনুমোদন ছাড়া ওই বনভূমিতে ক্যাম্প স্থাপন না করার অনুরোধ করেন তিনি। গত ৩১ জুন মহাপরিচালকের পক্ষে বিজিবির পরিচালক লে. কর্নেল মো. জিয়াউল হাসান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে চিঠি দেন। তাতে বলা হয়, ‘রামুর মতো স্পর্শকাতর এলাকায় বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপস্থিতি জরুরি। প্রধান বন সংরক্ষকের দপ্তর থেকে পাঠানো চিঠি অনাকাঙ্ক্ষিত, যা রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষায় তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।’ ২১ জুন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। বৈঠকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুল হান্নানকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটি শিগগিরই এলাকা পরিদর্শনে যাবে বলে জানা গেছে।