গোটা পৃথিবী মুসলমানের হাতে আসতে খুব বেশী দেরী নেই
উবায়দুর রহমান খান নদভী: নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি মানব সন্তান প্রকৃতির ধর্ম ইসলামের উপরই জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ মানুষের স্বভাবধর্ম আল্লাহর উপর আস্থা, বিশ্বাস এবং আল্লাহর রাসূলের সাথে আনুগত্য ও ভালবাসার সম্পর্ক। এ ধর্ম হৃদয়ে ধারণ করেই প্রতিটি মানবসন্তান পৃথিবীতে আসে। অতঃপর তার পিতা-মাতা ও পরিবেশ তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায়, অগ্নি অথবা মূর্তিপূজক বানায়।’ হাদীসের এ বাস্তবতা থেকে বোঝা যায়, স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ নাস্তিক বা ধর্মদ্রোহী হয় না। আল্লাহর সাথে শরিক কিংবা রাসূল (সা.) কে অমান্য করা মানুষের স্বভাব সম্মত নয়। এক আল্লাহতে বিশ্বাস ও আত্মনিবেদন (তাওহীদ) নবী রাসূলগণ, বিশেষত শ্রেষ্ঠনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি আনুগত্য, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা (রিসালত) এবং পরলোকে গমন, হিসাব-কিতাব, বিচার ও জান্নাত-জাহান্নামে (ঈমান, আমল তথা বিশ্বাস ও কর্মভেদে) অনন্তকাল অবস্থান (আখিরাত) ইত্যাদি বিশ্বাস করার নামই সত্য ধর্মকে ধারণ করা। যে কোন ধর্মীয় পরিচয়েই কেউ যদি এ বিশ্বাস পোষণ করেন, তাহলে আল্লাহর হিসাবে তিনি মুসলমান। কেবল সে ধর্মই সত্য যেখানে তাওহীদ, রিসালত ও আখিরাতের ধারণা নিখাদ স্পষ্ট রয়েছে। এর আলোকে আমরা প্রচলিত প্রতিটি ধর্মের সত্যাসত্য পরখ করে দেখতে পারি। কোন ধর্মগ্রন্থই বলে না যে, ইসলাম শ্রেষ্ঠ, একমাত্র চিরআধুনিক ও সর্বশেষ চূড়ান্ত ধর্ম নয়। তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল, বাইবেল, গীতা, বেদ, উপনিষদ, জিন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক, গ্রন্থসাহেব ছাড়াও জানা-অজানা সকল ধর্মগ্রন্থের মূলবাণীই হচ্ছে এক আল্লাহ, শ্রেষ্ঠনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মরণোত্তর জীবন, আখিরাত এবং আত্মসমর্পণপূর্বক স্রষ্টার অনুশাসন মেনে চলা।
অনেক ওলী-দরবেশকে বলতে শোনা গেছে যে, ইসলাম যেহেতু স্বভাবধর্ম, প্রকৃতিগত মানবধর্ম, সুতরাং এটি তার অন্তর্নিহিত শক্তিতেই মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে। অবিশ্বাস, ধর্মহীনতা ও কুসংস্কার দূর করে দিলেই ইসলামের আলো মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করে। বরং বলা উচিত যে, অন্তরের ভেতরগত আলো তখন প্রস্ফুটিত হয়। ময়লা ও অন্ধকার দূর হলে যেমন কোন জায়গা নিজে থেকেই পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত হয়ে থাকে। যে কোন ধর্মের অনুসারী যদি অভিন্ন মানবধর্ম বা স্বভাবগত প্রাকৃতিক ধর্মবিশ্বাস খুঁজে নিতে চান তাহলে তার পক্ষে তার নিজ ধর্মের গ্রন্থ ও শিক্ষা থেকেও প্রকৃত ধর্মের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। কেননা, কোন আদি ধর্মগ্রন্থই বলেনা যে, আল্লাহর কোন শরিক আছে। দুনিয়ার কোন নবী-রাসূলকে অস্বীকার করা যাবে। মূর্তিপূজা করা যাবে। আল্লাহর কাজের উপর কোন দেব-দেবীর বিন্দুমাত্রও প্রভাব আছে। বিশ্বনবী (সা.) কে অস্বীকার করে কেউ সত্যধর্মের সন্ধান পাবে কিংবা সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করতে পারবে। পরকাল ও জবাবদিহিতা বলতে কিছু নেই অথবা মানুষ ভালো মন্দের বিচার শেষে একসময় স্বর্গ বা নরকে যাবে না।
তাহলে এমন একটি সার্বজনীন ধারণা ও বিশ্বাস যখন সকল ধর্মেরই মূল শিক্ষা তাহলে আল্লাহ মনোনীত একমাত্র সত্যকে গোটা বিশ্ববাসীর সর্বান্তকরণে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? ইসলামের অনুসারীরা তো দুনিয়ার প্রতিটি ধর্মের শুদ্ধ অংশটিকে সম্মান করেন, তারা তো অতীতের সকল নবী-রাসূল ও ঐশী বার্তাবাহকদের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং সম্মান করেন। নিজ ধর্মে অটল থাকার পাশাপাশি তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সামনে সত্য ধর্মের পরিচয় তুলে ধরেন। কিন্তু কোন মানুষকে জোর করে ধর্মগ্রহণ করান না। এ জন্য বিশ্বের যে সব জায়গায় মুসলমানরা শাসকরূপে পাঁচশ’, সাতশ এমনকি হাজার বছর ধরে বসবাস করেছেন, যেসব জায়গায়ও তারা চিরদিনই সংখ্যালঘু ছিলেন, বর্তমানেও তাই আছেন। কারণ, জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করা ইসলামে ছিলনা এবং এখনও নেই। বিনা জোর-জবরদস্তি কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে ইসলাম অনুসারীরা তাকে স্বাগত জানায়। ইসলামের সৌন্দর্য সততা ও শ্রেষ্ঠত্বে মুগ্ধ হয়ে যারা এতে প্রবেশ করে তাদের জন্য মুসলমানদের হৃদয়ের দুয়ার চিরদিনই খোলা।
অমুসলিমদের ব্যাপারে মুসলমানদের কর্মনীতি কী বা কেমন, তা ইতিহাস ভালো বলতে পারবে। আরববিশ্বে অমুসলিমরা সাক্ষ্য দেবেন ইসলাম তাদের সাথে কী আচরণ করেছে। স্পেনের খ্রিস্টানরা বলতে পারবেন ইসলাম তাদের কী কী দিয়েছে। গোটা ইউরোপ তার উন্নতি ও সভ্যতায় ইসলামকে কেমন পেয়েছে তা সেই বলতে পারে। উপমহাদেশ জানে মুসলমানরা তাকে কী দিয়েছে, কতটা ভালোবেসেছে আর ভবিষ্যতে কী কী দিতে পারে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও দূরপ্রাচ্য মুসলমানদের কাছ থেকে দেখছে, জানছে এবং বুঝতেও পারছে। মুসলমানের উদার, মানবিক, ইতিবাচক উপস্থিতি কারো জন্যেই অপ্রীতিকর হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে যেসব দেশ ও জাতি শিক্ষিত, সভ্য, উন্নত এবং আধুনিক। যে সমাজে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত সেখানে তো মুসলমানের চলতে, বলতে, জীবনযাপন করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
তাহলে কোন কোন জায়গায় কেন বৈরী বাতাস বইতে দেখা যায়? কেন শোনা যায় বিদ্বেষের বাণী। মুসলমানদের কেন জঙ্গী-সন্ত্রাসী বানানোর প্রাণান্ত প্রয়াস। কেন তাদের ধর্মীয় অধিকার নস্যাতের অপচেষ্টা। যে সমাজে মানুষ নগ্নতার অধিকার পায়, সেখানে মুসলমানেরা কেন পোশাক পরার অধিকারটুকু পাবে না?
যে সব দেশে বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা, সমলিঙ্গে যৌনতা, ইচ্ছেমত অবাধ বিকৃত জীবন অনুমোদিত, সে দেশে মুসলমানরা তাদের ধর্মসম্মত পবিত্র ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনপদ্ধতি নিয়ে কেন বসবাস করতে পারবে না। অন্যরা যদি ‘হারাম’ খেতে পারে নির্দ্বিধায়, তাহলে মুসলমানরা কেন ‘হালাল’ খেতে পারবে না? যদি অন্য নারীরা শরীর খোলা রাখার অধিকার পায়, বিবসনা বা স্বল্প বসনা হয়ে চলাফেরার সুযোগ পায় তাহলে মুসলিম নারীরা কেন শালীন পোশাক ও হিজাব পরতে পারবে না। যদি পিতৃ পরিচয়হীন ও কুমারি মায়ের শিশু কোন সমাজের সংস্কৃতি হয়ে যায় তাহলে মুসলমানরা কেন বিয়ে-শাদী, মা-বাবার পরিচয়, বৈধ শিশুর পবিত্র ও সুশৃংখল সংস্কৃতি ধরে রাখার সুযোগ পাবে না?
সংবাদপত্রে ইদানীং পশ্চিমা নানা দেশে ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য নিয়ে কিছু লোককে মাঠে নামতে দেখা যাচ্ছে। মুসলমানদের ধর্ম, রীতি, সংস্কৃতি ও আদব-আখলাকের বিরুদ্ধে বিষোদগারসহ তাদের নির্মূল, উৎখাত, ধ্বংস, বহিষ্কার ইত্যাদি দাবি তুলতেও শোনা যায় অনেক স্থানে। অস্ট্রেলিয়ার একটি বিক্ষোভ সমাবেশে প্রতিবাদকারীদের দেখা গেছে, নো ইসলাম, নো হালাল, নো শরীয়াহ প্ল্যাকার্ড বহন করতে। এ সংগঠনের লোকেরা এতটাই মারমুখী যে কোন কোন জায়গায় তারা মুসলমানদের উপর হামলারও পাঁয়তারা শুরু করে। কিছু জায়গায় হালকা মারামারিও হয়, পুলিশী হস্তক্ষেপের ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণে আসে। পাল্টাপাল্টি ক্ষোভ প্রকাশও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
ভারতে সবসময়ের মত সম্প্রতিও কিছু হিন্দুবাদী নেতা মুসলমানদের পুনরায় হিন্দু বানানোর প্রজেক্ট চালু রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন, সরকার বাধা দিলেও তারা হিন্দুকরণ চালিয়ে যাবেন। তাছাড়া অনেক নেতা বারবার বলার চেষ্টা করছেন, হিন্দুদের অধিক সন্তান নেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা। কারণ, হিসেবে দেখাচ্ছেন, মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও দ্রুত বর্ধনশীল অনুসারী।
বিশেষ করে সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চের একটি পরিসংখ্যান অনেকের জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। যদিও এ গবেষণায় কিছু ধর্মকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট করা হয়েছে এবং বিশেষ কিছু ধর্মকে অস্বাভাবিক হাইলাইট করা হয়েছে। যা বাস্তবতার সাথে যায় না। ২০৫০ সালে বিশ্বে ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা ও ২০৭০ সালে ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার হার এবং তুলনামূলক অবস্থান থেকে কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু এর পেছনে কোন যুক্তি নেই। যদি স্বাভাবিকভাবে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যদি স্রোতের গতিতে লাখো মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে তাহলে তাদের সংখ্যার হারও বৃদ্ধি পাবে, এতে ক্ষোভের কি থাকতে পারে। যদি ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে ভারতের মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তাহলেই বা সমস্যা কোথায়?
ভারত তো মুসলমানদের জন্য ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই উন্মুক্ত। দেড় হাজার বছর ধরে মুসলমান এ অঞ্চলে আছে। অখ- ভারতে মুসলমানের শাসনকালও ছিল বহু শতাব্দী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অসাধারণ। একজন দু’জন করে ইসলাম গ্রহণকারী ভারতীয় আর মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী মানুষ মিলে বর্তমানে তাদের সংখ্যা ৩৫ কোটির মত হবে হয়তো। স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আরো ৩৫ কোটি তো হবেই। আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, সিকিম, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ইত্যাদি মিলিয়ে আরো কিছু যদি ধরা যায় তাহলে এ অঞ্চলে মুসলমানের পরিমাণ ৮০ কোটির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া বিচিত্র নয়। কেবল ভারতেই ধর্ম বিশ্বাস করেন না, নিজেকে নাস্তিক বা যুক্তিবাদী দাবি করেন, নি¤œজাতের অনার্য মনে করেন কিংবা নিজেকে অহিন্দু বলে ভাবেনÑ এমন কোটি কোটি লোক রয়েছেন। তারা যদি মনে করেন ‘ইসলাম ধর্ম’ গ্রহণ করবেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হওয়ায় অসম্ভব নয়। পাশ্চাত্যেও ইসলাম গ্রহণের যে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতি, এতে ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়ায়ও মুসলিম জনসংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে গোটা পৃথিবী মুসলমানের কার্যকর দখলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এতে করে শেষ জমানায় গোটা দুনিয়া মুসলমানের হাতে চলে আসা সম্পর্কিত যে ভবিষ্যদ্বাণী হাদীস শরীফে এসেছে, সেটির বাস্তবায়ন যে বেশী দূরে নয়, এ কথাটিই কি প্রতীয়মান হচ্ছে না? নবী করিম (সা.) তো বলেছেন, তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে আমি রোজ হাশরে আল্লাহর দরবারে গর্ব করবো। তাছাড়া, দুনিয়ার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধিবাসী নিয়েই তো সংঘটিত হবে হযরত ইমাম মাহদী (আ.) এর বিপ্লব। কায়েম হবে বিশ্বব্যাপী ইসলামী মহা হুকুমত তথা খিলাফত।