ইউরোপ প্রবাসীদের মহাসম্মেলন ৩০-৩১ মে
মাঈনুল ইসলাম নাসিম: ‘নিরাপদ অভিবাসন ও মানবিকতা’ এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে ৩০ ও ৩১ মে আটলান্টিক তীরে লিসবনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা)’র দ্বিতীয় গ্র্যান্ড কনভেনশন। ইউরোপের ৩০টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশীদের এই মহাসম্মেলনকে সফল ও স্বার্থক করতে জোর প্রস্তুতি চলছে এখন পর্তুগালের রাজধানীতে। দুই দিনব্যাপী বিগ ইভেন্টটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে লিসবনের অভিজাত হোটেল সানা মালহোয়াতে। ইতিমধ্যে আয়েবা গ্র্যান্ড কনভেনশনের সাফল্য কামনা করেছেন লিসবনে দায়িত্বরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদ। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি সম্ভব সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেন দূতাবাসের তরফ থেকে।
রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদ সহ পর্তুগীজ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশী নারী-পুরুষরা গ্র্যান্ড কনভেনশনের বিভিন্ন সেশনে অংশ নেবেন। ‘সেইফ মাইগ্রেশন এন্ড হিউম্যানিটি’ শীর্ষক একাধিক সেমিনারও অনুষ্ঠিত হবে লিসবনের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে। সাম্প্রতিক সময়ে ভূমধ্যসাগরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী সহ কয়েক হাজার অভিবাসীর সলিলসমাধির প্রেক্ষিতে ‘নিরাপদ অভিবাসন’ সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি ‘মানবিকতা’ তথা মানবাধিকার রক্ষার জরুরী ইস্যুটি লিসবনে এবার লাইমলাইটে থাকবে, এই প্রতিবেদককে এমনটাই জানিয়েছেন আয়েবা প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ড. জয়নুল আবেদিন এবং সেক্রেটারি জেনারেল কাজী এনায়েত উল্লাহ।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালের ১২ অক্টোবর ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসেসিয়েশন সংক্ষেপে আয়েবার। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আয়েবার মূল উদ্যেক্তারা তার পরপরই ঢাকার প্রবাসী কল্যান ভবনে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সাথে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ১-২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক এথেন্স নগরীতে অনুষ্ঠিত হয় সংগঠনের প্রথম মহাসম্মেলন, যা উদ্বোধন করেন গ্রীক সরকারের ঐ সময়কার ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টার নতিস মিতারাকিস। রাষ্ট্রদূত আজিজুল হক সহ গ্রীক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা তখন যোগ দেন প্রবাসী বাংলাদেশীদের মহামিলনমেলায়।
ইউরোপের বহু দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী নারী-পুরুষদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে আলো জ্বলে ওঠে এথেন্সের প্রেসিডেন্ট হোটেল মঞ্চে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃত স্বরূপ ইউরোপের ১৬ জন স্বনামধন্য গুণী বাংলাদেশীকে আয়েবা অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। ২০১২ সালের আয়েবা অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তরা ছিলেন মেইনস্ট্রিম পলিটিক্সে যুক্তরাজ্যের এমপি রুশনারা আলী, নরওয়ের সাবেক এমপি সায়েরা খান ও পোল্যান্ডের সাবেক এমপি ড. হিউবার্ট রঞ্জন কস্তা, মেডিকেল সায়েন্সে অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অসীম দত্তরায়, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে নরওয়ের ইমিগ্রেশন বিভাগের চিফ আইটি অফিসার হাসিব রহমান, আর্ট ওয়ার্ল্ডওয়াইডে তিন স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী স্পেনের মনিরুল ইসলাম, ফ্রান্সের শাহাবুদ্দীন ও ডেনমার্কের রুহুল আমিন কাজল।
‘প্রমোট বাংলাদেশ’ ক্যাটাগরিতে চেক রিপাবলিক সরকারের স্বরাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রনালয়ের সাবেক কর্মকর্তা নাদিরা মজুমদার ও পোল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক, মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সুইডেন প্রবাসী একাত্তরের দুর্ধর্ষ গেরিলা কমান্ডার শহীদুল হক মামা ও স্পেনে ঐ সময় দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রদূত বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী ইখতিয়ার মোমিন এবং কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টে ইউরোপের ৪ ত্যাগী কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব স্কটল্যান্ডের ড. ওয়ালি তসর উদ্দিন, লন্ডনের আশরাফ উদ্দিন, প্যারিসের কাজী এনায়েত উল্লাহ এবং রোমের লুৎফর রহমানকে এথেন্সে আয়েবা অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়। ২০১২ সালের মতো এবারের লিসবন গ্র্যান্ড কনভেনশনেও ইউরোপের বেশ কয়েকজন গুনীজনকে একই অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির প্রধান, আয়েবা’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও লিসবন সিটি কাউন্সিলর রানা তাসলিম উদ্দিন।
এথেন্স গ্র্যান্ড কনভেনশনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে গ্রীসের ইঞ্জিনিয়ার ড. জয়নুল আবেদিনকে সভাপতি এবং ফ্রান্সের কাজী এনায়েত উল্লাহকে মহাসচিব করে আয়েবার কার্যকরী পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে। প্যারিসকে সংগঠনের সদর দফতর হিসেবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সবক’টি দেশের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য ‘ট্রেড মার্ক এন্ড কপিরাইট ইউনিক রেজিস্ট্রেশন’ সম্পন্ন হয় ফ্রান্সে। বাংলাদেশ ভিত্তিক রাজনৈতিক-সামাজিক-আঞ্চলিক বহুদাবিভক্ত দেশে দেশে বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে কাজ করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শুরু থেকেই কৌশলী হতে হয় আয়েবাকে। দেশ থেকে দেশান্তরে ত্রৈমাসিক সভা নিয়মিত আয়োজনের মাধ্যমে ইউরোপ জুড়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে নতুন ধারার এই ব্যতিক্রমধর্মী আন্তঃদেশীয় সংগঠন।
ইউরোপের প্রতিটি বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে কাজ করার ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় দেন আয়েবা নেতৃবৃন্দ। ২০১৩ ও ২০১৪ বছরজুড়ে ইউরোপের দেশে দেশে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশীদের সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন আয়েবা নেতৃবৃন্দ। গ্রীসের স্ট্রবেরি খামারে গুলীবর্ষণের ঘটনায় আহত অবৈধ বাংলাদেশীদের ‘স্টে পারমিট’ পাইয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন আয়েবা নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন দেশে বহু বাংলাদেশীকে রাজনৈতিক আশ্রয় পাইয়ে দিতেও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন তাঁরা। দেশে দেশে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃবৃন্দের সক্রিয় অংশগ্রহনের পাশাপাশি প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রশাসনের সাথে ফলপ্রসু যোগাযোগের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে ইউরোপের সাড়া জাগানো এই সংগঠন।
আয়েবা নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতায় প্রবাসীদের ন্যায্য দাবীদাওয়া ইতিমধ্যে স্থান পেয়েছে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এমনকি বঙ্গভবনেও। বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায়ও স্বার্থক অংশীদার অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসেসিয়েশন (আয়েবা)। রানা প্লাজা ট্যাজেডি পরবর্তী বাংলাদেশের তৈরী পোষাক শিল্প যখন ইউরোপের বিশাল বাজারে হুমকির মুখে, তখন প্যারিসের ‘আয়েবা হেড অফিস’ থেকে ফ্রান্স-জার্মানী সহ ব্রাসেলসের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে কর্মকর্তা পর্যায়ে জোরালো লবিং চালিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশের প্রধান এই রফতানী খাতের স্বার্থরক্ষায়। স্বল্প সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসামান্য অবদান রাখা ‘অরাজনৈতিক ও অলাভজনক’ সংগঠন আয়েবার সাংগঠনিক কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে আসন্ন লিসবন গ্র্যান্ড কনভেনশনে এর পরিচালনা পর্ষদকে সুনিপুনভাবে ঢেলে সাজানো হবে বলে আশা করা হচ্ছে।