ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয় : দু:খ হয় ঐশীর জন্য
আফরোজা খানম
ষোড়শী কন্যা ঐশী। খুন হওয়া পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমানের বড়ো মেয়ে ঐশী মাদকাসক্ত। সে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করে। বন্ধুদের সঙ্গে রাত কাটায়। এমনকি অনেক রাতে বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফিরতো। এ নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই বন্ধুদেরকে দিয়ে খুন করায় পিতা-মাতাকে।
ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ঐশী নিজে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করা ঐশীর বিত্তবান বন্ধুদের তালিকাটিও অনেক লম্বা। বেশ কয়েকজনের সঙ্গেই তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে সে স্বীকার করেছে। স্বীকার করেছে ওই সব প্রেমিকের সাথে রয়েছিল শারীরিক সম্পর্কও।
আর এ কারণে তার বাবা বিভিন্ন সময় তাকে মারধোর করতেন, তার বখাটেপনায় বাধা দিতেন। বেশ কয়েকদিন ধরে তাকে বাসা থেকেও বের হতে দেয়া হয়নি।
এসব কারণে বন্ধুদের নিয়ে ঐশী তার বাবা-মাকে খুন করে। হত্যাকাণ্ডে তার চার থেকে পাঁচ বন্ধু অংশ নেয়। ছুরিকাঘাতে মাহফুজুর রহমান ও স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যা করা হয়। এ সময় সে পাশেই অবস্থান করছিল।
এর জন্য দায়ী কে? এক কথায় বলবো আমাদের সমাজ ব্যবস্থা? যে সময় হেসে খেলে বাড়ি মাতিয়ে রাখার বয়স সে সময় ঐশী কেন খুনের মতো ঘটনায় জড়িয়েছে? উত্তর মিলবে কার কাছে?
দেশে খুনোখুনি কোন নতুন ঘটনা নয়। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খুন হচ্ছেন। শুক্রবার রাতে ঢাকায় নিজ ফ্যাটে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান এবং তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের মৃত্যু নাড়া দিয়েছে গোটা দেশকে।
এই ধরনের কিশোর অপরাধের ঘটনা এটাই প্রথম না। এর আগেও আলোচিত ঘটনায় জড়িয়েছে নিজ পরিবারের সদস্য কিশোর-কিশোরীরা। কেন এমন হচ্ছে? কারণ কিশোর বয়স সব সময় বিপজ্জনক। এই সময়টাতে পরিবারকেই তাদের সদস্যদের আগলে রাখতে হয়। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের প্রবণতা সন্তানের সামাজিকীকরণে প্রভাব ফেলছে। স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানোর বদলে শিশু কিশোররা টেলিভিশন, ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছে বেশি। আর এতে ছোটো বয়সের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদানের প্রতি তৈরি হচ্ছে আসক্তি।
কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা পূরণ স্বজনদের সঙ্গে সরাসরি মেলামেশা বাড়ানো, তাদের সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, ভুলগুলো শুধরে নেয়ার চেষ্টা এবং নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
আবার বাবা-মাও সব সময় সন্তানকে ঠিকমতো দেখাশোনা করেন এমনটা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই কর্মজীবী বাবা এবং মা তাঁর সন্তানের স্নেহের চাহিদা পূরণ করতে পারেন না বাস্তব কারণেই। এসব সন্তানের বেড়ে উঠায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে বয়সন্ধিতে কিশোর-কিশোরীদেরকে ঠিক মতো দেখভাল না হলে তার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠায় ফেলে নেতিবাচক প্রভাব।
প্রায় ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের দুরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণে মূল্যবোধের যে ঘাটতি হচ্ছে তা কেউ খেয়াল করছে না। সামাজিক বিধি-বন্ধন থাকছে না। সন্তানরা অল্প বয়সে মাদকাসক্ত হচ্ছে অন্যদের দ্বারা। যারা মাদক ছড়াচ্ছে তাদের মূলে আঘাত করতে হবে। তা না হলে সমাজ ভেঙে পড়বে।
ফলে সমাজ ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। বিপথগামী হয়ে পড়ছে সন্তানরা। সামাজিকীকরণ ও সাংস্কৃতিকরণের এই সমস্যা থেকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হতে পারে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে বাবা মা অনৈতিকতায় জড়িত থাকার কারণে সন্তানদের নৈতিকতা শেখানোর সুযোগ পান না। এ ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্বায়নের ধাক্কায় পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে যাচ্ছে। আয়েশি জীবনের প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে সন্তানরা। ফলে ভালোমন্দ বুঝে উঠার আগেই অনৈতিক কর্মকা- করে ফেলছে।
শিশু-কিশোরদের অপরাধের সাথে যাতে করে জড়াতে না পারে এজন্য বাবা মাকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বেপরোয়া জীবন-যাপন আর ইয়াবার নেশায় মত্ত হয়ে ও-লেভেল পডুয়া ষোড়শী ঐশীই শেষ পর্যন্ত বনে যান বাবা-মায়ের হন্তারক। এ যেন দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষার মতো, যে কিনা পরিচর্যাকারীকেই দংশন করল সুযোগ বুঝে।
আর এই ঐশীর উদাহরণ টেনেই বলতে চাই, ‘দৈনন্দিন জীবন-যাপনে তীব্র উচ্চাকাক্সক্ষা সন্তানদের সামাজিক আনুগত্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে ঐশীর মতো তরুণ প্রজন্ম মা-বাবা হত্যার ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হচ্ছে না। বিশেষ করে কিশোর বয়সে মাদকের হাতছানি বড়ই বিপজ্জনক। এর কারণেই জীবনের এই সময়টাতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। মরণ নেশা ইয়াবাই ঐশীকে মানসিক বিকারগ্রস্ত করে তোলে।
আর এর জন্য দায়ী আমরাই। দায়ী আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। শুধু দু:খ হয় ঐশীর জন্য.. .. ..
[লেখক: মানবাধিকার কর্মী।]