ব্রিটিশ বনাম স্কটিশ জাতীয়তাবাদের লড়াই
মহীউদ্দীন আহমদ: যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে সব জনমত জরিপের ফল মোটামুটিভাবে ভুল প্রমাণিত করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবার সরকার গঠন করছে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। গত ৩০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে তারা। নিরঙ্কুশ বিজয়ে অভিভূত দলনেতা ডেভিড ক্যামেরন বলেন, কয়েক প্রজন্মের মধ্যে এটা দলের মধুরতম বিজয়। তিনি বলেছেন, ‘এমন এক দল ও সরকারের নেতৃত্ব দিতে চাই, যে দল ও সরকার অখণ্ড যুক্তরাজ্যে বিশ্বাসী।’
পার্লামেন্টের ৬৫০ আসনের মধ্যে সরকার গঠনে প্রয়োজন ৩২৬ আসন। কনজারভেটিভ দল পেয়েছে ৩৩১টি। প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি পেয়েছে ২৩২ আসন। ক্ষমতাসীন জোট সরকারের সহযোগী লিবারেল পেয়েছে ৪৯টি আসন। তারা অতীতে কখনোই ১৭ শতাংশের কম ভোট পায়নি অথচ এই নির্বাচনে তারা পেয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। এ দিকে, লেবার পার্টি সম্পূর্ণ ধরাশায়ী হলো স্কটল্যান্ডে।
এই নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে বিস্ময়কর উত্থান স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী দলের (এসএনপি)। দলটি পেয়েছে ৫৬টি আসন। স্কটল্যান্ডের ৫৯টি আসনের মধ্যে তিনটি ছাড়া সব ক’টি পেয়েছে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতার দাবিদার এসএনপি। স্বাধীনতার প্রশ্নে বিগত গণভোটে সামান্য ভোটে হেরে গেলেও জাতীয় নির্বাচনে স্কটল্যান্ডে তাদের নিরঙ্কুশ বিজয় এক অর্থে স্বাধীনতার পক্ষে পরোক্ষ গণরায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, তার কাছে যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতা সবার আগে। সমগ্র যুক্তরাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ রেখে এক জাতি হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। তবে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে এসএনপির বিষয়ে ক্যামেরনের বার্তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভোটারদের মগজ ধোলাই করার কাজটি সেরেছেন জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয়ার মাধ্যমে। তিনি ব্রিটিশদের বলেছেন, ইংলিশরা যদি তাকে এবং তার দলকে নির্বাচিত না করেন, তাহলে এসএনপির সহায়তায় মিলিব্যান্ড সরকার গঠন করবেন এবং তার ফলে স্কটিশ স্বাধীনতাকামীদের হাতে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি জিম্মি হয়ে থাকবে।’ তবে ক্যামেরনের বিজয়ে হতাশ হয়েছে পাশ্চাত্যের অনেকেই।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের টমাস রাইট বলেন, ক্যামেরনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র বেশ সন্দিহান। বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি খুব একটা আগ্রহী নন। তারা একটি শক্তিশালী যুক্তরাজ্য এবং একটি শক্তিশালী ইউরোপ দেখতে চান। তাদের মতে, ক্যামেরন যদি আগের মতোই চলতে চান, তবে যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির প্রভাব কমতে থাকবে।
এবারের নির্বাচনে বড় ইস্যুগুলোর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে অর্থনীতি, জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা নীতি আর অভিবাসন ইস্যু। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ব্রিটেনের থাকার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ক্যামেরন অঙ্গীকার করেছেন, বিজয়ী হলে দুই বছরের মধ্যেই ইইউতে থাকা-না-থাকার বিষয়ে তিনি গণভোটের আয়োজন করবেন। কনজারভেটিভদের দাবি, বিগত পাঁচ বছরে তারা সরকারের সেবা খাত ও কল্যাণভাতায় ব্যাপক ব্যয় কমিয়ে এনে বাজেট ঘাটতি পূরণে সক্ষম হয়েছে। ফলে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো, ব্রিটেনের অর্থনীতি এখন গতিশীল। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। অর্থনীতিকে বেগবান করতে আগামীতেও তাদের ভোট দিতে হবে। অভিবাসন ইস্যুতে তাদের বক্তব্য ছিল, তারা ইউরোপ থেকে অভিবাসনসংখ্যা কমাতে না পারলেও এশিয়া ও বাইরের বিশ্ব থেকে অভিবাসনসংখ্যা কমাতে পেরেছে। এই ইস্যুতে ভোটারদের টানতে তারা ইইউ থেকে সরে আসার জন্য গণভোটের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের কথা হলো, অবাধ চলাচল বহাল রেখে অভিবাসন ইস্যুর সমাধান সম্ভব নয়। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্যামেরন ইইউর সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে বিভিন্ন কারণে। ২০১৭ সালে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গণভোটের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে ব্রিটেন অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ইউরোপের বিশাল বাজার হারাবে। ফলে আগামীতে এই ইস্যুতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। এবারের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, অর্ধেক ব্রিটেনবাসী ইইউতে থাকার পক্ষে। এ দিকে ইইউ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক যুক্তরাজ্যকে ইউনিয়নে রাখার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালনের আভাস দিয়েছেন। টাস্ক বলেছেন, এ ব্যাপারে ক্যামেরনকে সহায়তা করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, ইউরোপের সাথে একযোগে কাজ করতে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা খুবই জরুরি। তার মতে, কোনো দেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে উন্নত জীবন পাওয়া সম্ভব নয়। ইইউ আরো শক্তিশালী হলে তা সব সদস্যরাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলের হবে। কারো কারো মতে, বেশির ভাগ ব্রিটিশ এই মুহূর্তে ইইউ ছাড়ার বিপক্ষে। কিন্তু গণভোটের প্রচারণা দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।
ব্রিটেনের এই নির্বাচনে এশীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ৬৫০ আসনের পার্লামেন্টে ১৫০ জন এশীয় প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ১১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনজন জয়ী হয়েছেন। চীনা বংশোদ্ভূত প্রার্থীও ছিলেন ১১ জন। জিতেছেন ১ জন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থী ছিলেন ৫৯ জন। এর মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন ১০ জন। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৫০ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন, যাদের মধ্যে ১০ জন জয় পেয়েছেন। শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত প্রার্থী ছিলেন চারজন, জয় পেয়েছেন একজন। এশিয়ান বংশোদ্ভূত এই ১৫০ জন প্রার্থীর মধ্যে কনজারভেটিভ দল থেকে ৩৬ জন, লেবার পার্টি থেকে ৩৫ জন ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটিকস দল থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন ৩২ জন।
এ দিকে স্কটল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী ও স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির নেতা নিকোলা স্টজিয়ন সদ্য নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের পর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনকে তার কথা শুনতেই হবে। নিকোলা বিবিসিকে বলেন, বাণিজ্য কর, চাকরি, সর্বনিম্ন পারিশ্রমিক এবং কল্যাণসংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য আমরা চাপ দেবো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রিটিশ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে দিতে পারে তাদের এ বিপুল বিজয়। কারো কারো মতে, এ বিজয় স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার লক্ষ্যে আরেকবার গণভোট আয়োজনের সুযোগও করে দিতে পারে। নতুন করে গণভোটের জন্য নতুন সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। তবে এসএনপি নেতা এখনো গণভোটের বিষয়ে খোলাসা করে কিছু বলেননি। ক্যামেরনকে যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় অনেক কঠিন লড়াই লড়তে হবে। তাকে লড়তে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা-না-থাকার বিষয়েও। বাস্তবতা হলো, প্রথম দফার তুলনায় দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন তার জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে। টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেভিড ক্যামেরন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতেও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জনপ্রিয় নেতা চার্চিলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে পত্রিকাটি বলেছে, ‘ক্যামেরনের জন্য এখনই সময় তার ভেতরকার চার্চিলকে খুঁজে বের করার।’ চমক জাগিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বড় জয় পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন ক্যামেরন। তিনি এখন যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতা ও জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে জোর দিলেও এসএনপি সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। একই অস্ত্র প্রয়োগ করে ডেভিড ক্যামেরন ও স্কটিশ নেত্রী নিকোলা নির্বাচনে বাজিমাত করেছেন। তাড়া নির্বাচনে জয়লাভের উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উসকে দিয়েছেন এবং নিজ নিজ অবস্থানে বিরাট বিজয় লাভ করেছেন। সেই বিবেচনায় যুক্তরাজ্যের এই নির্বাচনকে ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ বনাম স্কটিশ জাতীয়তাবাদের লড়াই বলা যায়।