আমেরিকার ৮/১ অংশ লোক ইমিগ্র্যান্ট
মোবায়েদুর রহমান: আমেরিকার একটি শুমারী মোতাবেক সেখানে অভিবাসীর সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার। মোট জনসংখ্যা ৩২ কোটি। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৮ ভাগের ১ ভাগই অভিবাসী বা ইমিগ্র্যান্ট। জনসংখ্যার এই বিশাল অংশকে আমেরিকার কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভবও নয়, বাস্তবও নয়। এই ৪ কোটি ১০ লাখের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখের বৈধ কাগজপত্র নেই। অবশিষ্ট ৩ কোটি বৈধ অভিবাসী তাদের সহযাত্রী এই ১ কোটি ১০ লাখ সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। যে দল বা যে নেতা এই ১ কোটি ১০ লাখ মানুষকে আমেরিকার বৈধ নাগরিক করবেন তাদেরই ভোট দেবে এই ৩ কোটি অভিবাসী। ৪০ বছর ধরে রাজনীতি করছেন হিলারি ক্লিনটন। এর মধ্যে ৮ বছর আরাকানসাসের গভর্নরের পত্নী হিসেবে আরাকানসাসের ফার্স্টলেডি এবং ৮ বছর প্রেসিডেন্টের পত্নী হিসেবে আমেরিকার ফার্স্টলেডি ছিলেন হিলারি। এছাড়া ৮ বছর ছিলেন নিউইয়র্কের সিনেটর। তার পক্ষে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়। তাই পত্রপত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক, আগামী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন অভিবাসী ইস্যুকেই তুরুপের তাস বানাতে চাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি দীর্ঘদিন থেকে অভিবাসীদের সমর্থন দিয়ে আসছেন। তার বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে অভিবাসীদের সেই সব তরুণ প্রজন্মের জন্য যারা ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন।
গত মঙ্গলবার নেভাদার প্রধান শহর লাসভেগাসের রাঞ্চো হাইস্কুলে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেয়ার সময় হিলারি বলেন, সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ণ নাগরিকত্ব দেয়ার ইস্যুটিতে আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না। এ ব্যাপারে রিপাবলিকানদের চেয়ে আমার অবস্থান ভিন্ন। তারা চায় তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্বের মর্যাদা দিতে। কিন্তু আমি দিতে চাই পূর্ণ নাগরিকত্বের মর্যাদা। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। বর্তমানে সিনেট রয়েছে ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদ রয়েছে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৩ সালে অভিবাসী আইনের যে সংস্কার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উত্থাপন করেন সেটি আটকে দিয়েছে প্রতিনিধি পরিষদ।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নেভাদা অঙ্গরাজ্যের ২৭ শতাংশের বেশি অভিবাসী। এদের প্রায় সবাই হিসপ্যানিক। এদের মধ্যে যারা অবৈধ তাদের কাউকে কাউকে সাময়িক ভিসা দেয়া হয়েছে, আবার কারো বাবা-মাকে অবৈধ অভিবাসীর তালিকায় রাখা হয়েছে। আগেই বলেছি, এই ইস্যুটি মার্কিন কংগ্রেসে ঝুলে আছে। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিক্যান উভয় দলই অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার ব্যাপারে ব্যাপক আইনগত সংস্কারে একমত। কিন্তু ভিসা কোটা ব্যবস্থার বিষয়টিতে দ্বিমত রয়েছে। গত নভেম্বরে কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অভিবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেন। এতে ৪০ লাখ অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট বহিষ্কারের হাত থেকে রক্ষা পায়। ওবামার এই উদ্যোগকে তত্ত্বগতভাবে ভালো মনে করলেও কংগ্রেসকে পাশ কাটানোয় রিপাবলিকানরা নাখোশ হয়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ওবামার নেয়া ব্যবস্থা কার্যকর করার আগ মুহূর্তে টেক্সাসের একটি আদালত এর ওপর জরুরি স্থাগিতাদেশ দেয়। এতে অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি ঝুলে যায়। যখন তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন তারপরও তার উদ্যোগ যদি কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করে তখন তিনি কি করবেন, এ ব্যাপারে হিলারী বলেন, কংগ্রেস যদি প্রত্যাখ্যান করতেই থাকে এরপরও বিষয়টিকে সামনে এগিয়ে নিতে আইনগতভাবে যা যা করার দরকার তার সবই করব। হিলারির এই ঘোষণা তার আগামী দিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কতটা সহায়তা করবে সেটা জানার জন্য আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
দুই.
ইমিগ্র্যান্ট ইস্যু বিশেষ করে অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে বাংলাদেশও উদ্বেগে রয়েছে। কারণ বর্তমানে আমেরিকাতে বাংলাদেশেরও রয়েছে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী। তাদের সংখ্যা সম্পর্কে একেবারে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করলে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ওইসব তথ্যে দেখা যায়, সমগ্র আমেরিকায় বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ অভিবাসী রয়েছে। শুধু নিউইয়র্কেই ১ লাখ ১০ হাজার ইমিগ্র্যান্ট রয়েছে বলে প্রকাশ। অন্যেরা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেসব অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা বেশি সেসব রাজ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ফ্লোরিডা, ইলিনয়, মিসিগান, উইসকনসিন, বোস্টন, আটলান্টা, ডেট্রয়েট, শিকাগো, মায়ামি, ডালাস, হিউস্টন, উত্তর ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া, মিনেসোটা প্রভৃতি। বাংলাদেশীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত যারা বৈধ কাগজপত্র পায়নি তাদের সংখ্যা আনুমানিক ৫০ হাজার। এদের অধিকাংশ বাস করছে নিউইয়র্কে। অবশিষ্টরা বাস করছে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে। এ কারণে হিলারির এই ঘোষণায় আমেরিকায় অবস্থানকারী বাংলাদেশী এবং তাদের বাংলাদেশে অবস্থানকারী আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও বিপুল আগ্রহ রয়েছে। আমেরিকায় এমন অনেক বাংলাদেশী রয়েছে যারা ২০ বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে, কিন্তু তারপরও তারা বৈধ কাগজপত্র পায়নি। সুতরাং বোধগম্য কারণেই তারা আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে, প্রতীক্ষা করছে, হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কিনা। হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়া নির্ভর করছে দুটি ধাপের ওপর। প্রথম ধাপটি হলো নিজ দলের ভেতর থেকে অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটিকদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন পান কিনা। এটি কয়েকটি প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে। আমরা অবশ্য ওইসব প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণে গেলাম না। আমরা ধরে নিচ্ছি যে হিলারি ডেমোক্র্যাটদের চূড়ান্ত নমিনেশন পেলেন। তারপরও কি তিনি অত সহজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন? হয়তো পারবেন। কিন্তু এই পথে কতগুলো অন্তরায় রয়েছে।
তিন.
হিলারি ক্লিনটন একজন চৌকস আইনজীবী। আমেরিকার ১০০ শ্রেষ্ঠ আইনজীবীর তিনি অন্যতম। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৮ বছর আমেরিকার সিনেটর ছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রথম মেয়াদে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ৮ বছর আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের ফার্স্টলেডি এবং ৮ বছর আমেরিকার ফার্স্টলেডি ছিলেন। রাজনীতি, আইন এবং প্রশাসন সম্পর্কে তার বিপুল অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেশের শীর্ষ প্রশাসনকে তিনি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন। সুতরাং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি যে একজন সুযোগ্য প্রেসিডেন্ট হবেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়।
এ জন্যই কথা থাকে যে, আমেরিকায় প্রেসিডেন্সির ইতিহাস ২২৬ বছরের। এই ২২৬ বছরে দেশটিতে ৫৭ জন প্রেসিডেন্ট এসেছেন। কিন্তু এই সুদীর্ঘ ২২৬ বছরেও আমেরিকানরা কোনো মহিলাকে তাদের প্রেসিডেন্ট বানায়নি। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এবং সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। নারী স্বাধীনতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে মার্কিনিরা সবসময়ই মুখর। নারীদের ব্যাপারে তাদের বিশাল ঔদার্য। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বেলায় বিগত ২২৬ বছরে তারা এই ঔদার্য দেখাতে পারেনি। অথচ যারা তাদের মতো উন্নত দেশ নয়, যারা এখনও উন্নয়নশীলদের তালিকায় আছে তারা নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে অনেক উদারতার প্রমাণ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, সংসদীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, সংসদ উপনেতা নারী, স্পিকারও নারী। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নারী ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রতিভা পাতিল, পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শ্রীমাভো বন্দর নায়েকে এবং তার কন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। তাই প্রশ্নটি রয়েই যায় যে, আমেরিকা কি এবার একজন মহিলাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে?
হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে একটি ঐতিহ্যগত অন্তরায় রয়েছে। সেটি হলো অসাধারণ ব্যতিক্রমধর্মী ক্যারিয়ার না হলে মার্কিনি ঐতিহ্যে কোনো দল বা ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয় না। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। রিপাবলিকানদের তিনবার দুই মেয়াদের বেশি এবং ডেমোক্রেটদের দুইবার দুই মেয়াদের বেশি মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়েছিল। একাধিক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড করেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। তিনি ৪ বার প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু ৪র্থ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫ মাস পর ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তারই দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হ্যারি এস ট্রুম্যান। তিনিও দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে দেখা যায় যে, ডেমোক্র্যাটদের মধ্য থেকে দুজন প্রেসিডেন্ট এক নাগাড়ে ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
অন্যদিকে রিপাবলিকানরা তিনবার দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন করেন। ইউলিসিস গ্র্যান্ট, রুদারফোর্ট জেমস গারফিল্ড এবং চেস্টার আর্থার একনাগাডে ১৬ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অর্থাৎ মার্কিন জনগণ পরপর চারটি মেয়াদে রিপাবলিকানদের প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছে। দ্বিতীয় দফাতেও এর পুনরাবৃত্তি হয়েছে। উইলিয়াম ম্যাকিন লে, থিওডর রুজভেল্ট এবং উইলিয়াম টাফট এক নাগাড়ে তিন মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৩ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। রোনাল্ড রিগান এবং জর্জ বুশও এক নাগাড়ে তিন মেয়াদে অর্থাৎ ১২ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
এভাবে বিচার করলে হিলারিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলে অর্থাৎ তৃতীয় মেয়াদে এবার ডেমোক্রেটদের ওই অফিসে বসালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদে বারাক ওবামা এমন কোনো চমক দেখাতে পারেননি। অথবা হিলারি ক্লিনটন এমন কোনো ক্যারিসম্যাটিক নেতা নন যে তার দলকে তৃতীয় মেয়াদে ভোট দিতেই হবে। তবে ওবামা অর্থাৎ একজন কৃষ্ণাঙ্গকে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে মার্কিনিরা যেমন ‘বিপন্ন বিস্ময়’ সৃষ্টি করেছেন তেমনি হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, অর্থাৎ একজন মহিলাকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে মার্কিনি জনগণ যদি আরেকটি বিপন্ন বিস্ময় সৃষ্টি করে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।