ধর্মনিরপেক্ষতার নামে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শিকভাবে মানুষকে ধর্মহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে : শাহ আহমদ শফী
হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিয়া-সুন্নী সংঘাত উস্কে দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের দেশেও ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও আঘাত চালানো হচ্ছে। উলামা-মাশায়েখ ও মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে কথিত জঙ্গীবাদকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দাড়ি-টুপী ও হিজাব পরিহিতা মুসলমান নারী-পুরুষ নানাভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শিক ভাবে মানুষকে ধর্মহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
শুক্রবার জুমাবার দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের খতমে বুখারী ও দোয়া মাহফিলের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীস (স্নাতকত্তোর) সমাপনী বর্ষের হাদীস শাস্ত্রের সর্বনির্ভরযোগ্য গ্রন্থ বোখারী শরীফ এর শেষ ক্লাসের পর আখেরী মুনাজাত ও বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সমাপনী ক্লাস ও দোয়া মাহফিল পরিচালনা করেন দেশের শীর্ষ আলেম হেফাজতে ইসলামের আমীর ও দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদীস পীরে কামেল আল্লামা শাহ আহমদ শফী। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই দ্বীনি সমাবেশে দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল)এর সমাপনী দরস সম্পন্ন হয়। বিকেল সাড়ে ৩টায় হাদীস শাস্ত্রের বিশুদ্ধ ও প্রধান কিতাব বুখারী শরীফের আখেরী দরস বা সমাপনী ক্লাস শেষ হয়।
আখেরী দরসের পূর্বে বিদায়ী তরুণ আলেম এবং সমাবেশে উপস্থিত হাজার উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতী কিফায়াতুল্লাহ, মুফতি জসীম উদ্দীন, মাওলানা ফোরকান আহমদ, মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী প্রমুখ।
বিকাল সাড়ে ৩টায় হাদীস শাস্ত্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিখ্যাত গ্রন্থ সহীহ বুখারী শরীফের আখেরী দরস আরম্ভ হয়। দরসের শুরুতে আখেরী হাদীসের পুরো সনদসহ মতন পাঠের পর হযরত আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে হাদীসের উপর বিশদ আলোচনা করেন। আলোচনায় হাদীসের বিশুদ্ধ কিতাব বুখারী শরীফ ও এর রচয়িতা ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী (রাহ.)এর কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ইমাম বুখারী (রাহ.) দীর্ঘ ১৬ বছর পর্যন্ত সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ১,০৮০ জন উস্তাদ থেকে অর্জনকৃত ৬ লক্ষ হাদীস থেকে বাচাই করে ৭,২৭৫টি হাদীস সংকলন করেছেন। প্রত্যেক হাদীস লেখার পূর্বে গোসল করে দুই রাকাত নামায আদায় করে আল্লাহ্ তাআলার দরবারে এই দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! হাদীস যদি ভুল হয়, তাহলে শুদ্ধতা অন্তরে ঢেলে দিন। রওজায়ে আক্বদাসের পাশে বসে ৩,৩৮৮টি বাব (অধ্যায়) নির্ধারণ করেছেন। আল্লামা শাহ আহমদ শফী এ ব্যাপারো আরো বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে হেফাজত আমীর আরো বলেন, যেকোন নেতিবাচক ও অঘটনের সাথে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উলামা-মাশায়েখ ও ইসলামপন্থীদেরকে জড়ানোর চেষ্টা চলছে। ইসলামের আবশ্যকীয় বিভিন্ন বিধি-বিধানের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডে ন্যাস্তিক্যবাদি ব্যক্তি সংগঠনের পাশাপাশি সরকারের উচ্চপদস্থ লোকজনকেও প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডে উস্কানী দিতে দেখা যায়। দেশের উলামায়ে কেরাম ও তৌহিদী জনতা গভীরভাবে বার বার উদ্বেগ জানানো সত্ত্বেও সরকারীভাবে এসবের প্রতিকারে কোনই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকব্যবাদিদের নানামুখী পদক্ষেপে ঈমান ইসলাম নিয়ে বসবাস করাটাই এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। হেফাজত আমীর ঈমান ও ইসলামের হেফাজতের লক্ষ্যে উলামা-মাশায়েখ ও সাধারণ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের উপর গুরুত্বারোপ করে তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই কঠিন পরিস্থিতিতে ইসলামের শান্তি, সাম্য ও ঐক্যের বাণী জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে আপনাদেরকে জোরদার ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি নাস্তিক্যবাদের অপতৎপরতা এবং ইসলাম ও নৈতিকতা বিরোধী কর্মকান্ডের বিষয়েও ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরী করতে হবে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তরুণ আলেমদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, বর্তমানে দেশে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মূলত: জাতিকে ধর্মহীন ও আদর্শহীনভাবে গড়ে তোলে ভোগবাদিতায় নিমগ্ন করার জোর আয়োজন চলছে। ইসলাম ও মুসলমানদের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করা হচ্ছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উলামা-মাশায়েখের বিরুদ্ধে বহুমুখী মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র চলছে। এমন দূর্যোগকালীন সময়ে জাতিকে ধর্মহীনতার হাত থেকে উদ্ধারের জন্য আপনাদেরকে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কঠোরভাবে ইসলাম ও দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। আল্লামা শাহ আহমদ শফী তরুণ আলেমদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মৃত্যু আমাদের একদিন অবশ্যই হবে। সুতরাং মুসলমান কখনো মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয় না। আর সেই মৃত্যুটা যদি শাহাদাতের মৃত্যু হয়, তা তো একজন মুসলমানের জন্য অবশ্যই গর্বের বিষয়।
খতমে বুখারী ও দোয়া মাহফিল সমাবেশে হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী খতমে বুখারীর দরসে ইলমে হাদীসের ইতিহাস ও তাৎপর্য বর্ণনা করার পর বলেন, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার দিক দিয়ে জাতিকে ধর্ম ও আদর্শহীন করে ভোগবাদিতায় লিপ্ত করে ক্ষমতালোভীরা দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখলে রাখতে চায়। জুলুম-অত্যাচার ও ভোগবাদিতার পথে তারা ইসলাম ও উলামা-মাশায়েখগণকেই বড় বাধা মনে করছেন। সুতরাং তরুণ আলেমদেরকে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলায় বুদ্ধিমত্তার সাথে জোরদারভাবে কাজ করতে হবে। হেফাজত মহাসচিব আরো বলেন, সম্প্রতি ধর্মমন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পবিত্র কুরআন-হাদীসের ভাষা আরবীকে যত্রতত্র প্রস্রাব বন্ধ করার কাজে ব্যাবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এটাও ইসলাম বিরোধী আরেক ষড়যন্ত্র। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, এদেশের সব মানুষ মুসলমান নয়। অমুসলিমদের কাছে আরবী ভাষার মর্যাদা সমান নয়। তাছাড়া প্রস্রাবের স্থলে আরবী ভাষার ব্যাপক ব্যাবহারের মাধ্যমে মূলত: মুসলমানদের মন থেকে আরবী ভাষার পবিত্রতা ও মর্যাদাবোধ নষ্ট করার এটা ষড়যন্ত্র হতে পারে বলে জোর সন্দেহ হয়।
হেফাজত আমীর প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদ সন্ধ্যায় প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, খতমে বুখারী ও দোয়া মাহফিলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পেরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আলহাজ্ব আজম নাসির উদ্দীন শরীক হয়ে ছিলেন। সিটি মেয়র আ জ ম নাসির হেফাজত আমীরের সাথে কুশল বিনিময় করে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন। হেফাজত আমীর খতমে বুখারীর ও দোয়া মাহফিলে শরীক হওয়ার জন্য সিটি মেয়রকে ধন্যবাদ জানান। অন্যান্যদের মাঝে হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস আল্লামা শামসুল আলম, মুহাদ্দিস মাওলানা মুমতাজুল করীম (বাবা হুজুর), মাওলানা মুহাম্মদ ওমর, মাওলানা আহমদ দীদার, মাওলানা কবীর আহমদ, মাওলানা আনাস মাদানী, মাওলানা মুনির আহমদ, মাওলানা শফিউল আলমসহ শীর্ষ পর্যায়ের ইসলামী নেতৃবৃন্দ, উলামা-মাশায়েখ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সহ তৌহিদী জনতা শরীক হন।
দরস ও হিদায়াতী বয়ান শেষে আল্লামা শাহ আহমদ শফী বিদায়ী ছাত্র, উপস্থিত মুসল্লী এবং দেশ ও মুসলিম জাতির কল্যাণ ও শান্তির জন্য বিশেষ মুনাজাত পরিচালনা করেন। মুনাজাত পরিচালনার সময় ‘আমীন’ ‘আমীন’ রবে সমগ্র জামিয়া ক্যাম্পাসে কান্নার রোল পড়ে যায়। বিদায়ী ছাত্ররা মা-হারা সন্তানের ন্যায় অঝোরে কাঁদতে থাকে।