মুসলিম মেয়ের জন্য খ্রিস্টান মায়ের কষ্টগাঁথা

Alenaআমার মেয়ে এলেনাকে যখন ক্যালিফোর্নিয়ার জন ওয়েইন বিমানবন্দরে বিদায় জানাচ্ছিলাম তখন আশপাশের লোকজন আমাদের দিকে হা করে তাকিয়েছিল। এলেনা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং কখনো তার মাথা থেকে স্কার্ফ নামে না।
পরিবেশটা একটু হালকা করতে এলেনা হাসল। এরপর বলল, ‘আমি এয়ারপোর্ট খুব অপছন্দ করি। বিমানে উঠার সাথে সাথেই লোকজন কী বলবে তাও আমার জানা আছে। ওরা বলবে ‘হায় ঈশ্বর, এ তো মুসলিম!’
এর আগের দিন ন্যাশভিল বিমানবন্দরে এক নিরাপত্তাকর্মী এলেনাকে পুরোপুরি তল্লাশি করেন। শেষমেশ তার সাথে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগটি তল্লাশি করে দাবি করেন তাতে নাকি ‘বিস্ফোরক’ আছে!
এলেনা চোখ কপালে তুলে বলে ‘বিস্ফোরক!’
আসলে ব্যাগটিতে ছিল সদ্য কেনা কিছু কসমেটিক্স। বিমানবন্দরের লোকজন ‘লিপিস্টিক অ্যালার্ট’ দিয়ে রেখেছিল বোধহয়!
আমার মেয়ে হাসার চেষ্টা করে বলছিল, ‘লোকটা আমার হাত দুটি খুঁটে খুঁটে চেক করছিল!’
কিন্তু কথাগুলো বলার সময় এলেনার দুটো চোখ বেদনার্ত ছিল। মেয়ের কষ্ট দেখে আমিও কষ্ট পাই। দুনিয়া জুড়ে বিস্ফোরক বহন না করা কোটি কোটি মুসলসমানের জন্যও আমার কষ্ট লাগে। তারা আসলে কখনো তাদের কসমেটিকসের ব্যাগে বিস্ফোরক নিয়ে বেড়ায় না। আমার কষ্ট লাগে তাদের জন্যও, যারা মুসলমানদের ভয়ে সব সময় ভীত হয়ে আছে।
ছোট থাকতে ‘অন্যদের ভয়’ নিয়ে আমাকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে একজন কালো মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠতে গিয়ে সহ্য করতে হয়েছে কত শত বাঁকা চাহনি। এটা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদের সন্দেহপ্রবণ চোখকে এড়িয়ে চলতে বন্ধুবান্ধবদের মতো আমারও সব চেষ্টা ব্যর্থ হতো। কখনো উপেক্ষা করা, কখনো এসবকে নিছক মজা হিসেবে নেয়া, আবার কখনো রাগ করা- এসব কোনো কৌশলই কাজ করতো না।
তবে আমার মেয়ের বেলায় আমি সত্যিকারের কিছু করতে চাই।
আমরা জাতি হিসেবে সবসময়ই বর্ণগত দিক থেকে বিভাজিত ছিলাম। মানুষের গায়ের রং নিয়ে আমাদের মধ্যে এমনিতেই ভীতি কাজ করে। তার সাথে ধর্মীয় বিভাজন টানার পর সেটি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
সে দিন যে কার্টুন প্রতিযোগিতাটি হচ্ছিল (যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে), তা কি মুহাম্মদ (সা.) এর ক্যারিক্যাচার প্রদর্শনের জন্যই শুধু? না, তা নয়। প্রতিযোগিতার মূল বিষয়টি শিল্প বা অবাধ মতপ্রকাশের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। ওটা ছিল মূলত ‘ভীতি’ থেকে আয়োজিত।
শুধু অন্য মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতা আমাদেরকে এক ধরনের ‘ঘৃণা ফেরি করা প্রাণী’তে পরিণত করছে। অথচ আমাদের বিবেক শান্ত হতে বলে। একজন মানুষকে সন্ত্রাসী মনে না করে তাকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়ার কথা বলে। কিন্তু আমাদের মাথায় থাকা শয়তানটি তা না করে ‘লিপিস্টিক অ্যালার্ট’ বাজায়! টেক্সাসে আয়োজিত কার্টুন প্রতিযোগিতাটি ছিল অন্যের ধর্মকে হেয় করার আরেকটি দুঃখজনক প্রচেষ্টা।
তাহলে আমরা এখন কী করবো?
আমি ২০০১ সাল থেকে এই প্রশ্নটি করে আসছি, যখন কলেজ থেকে এলেনা একদিন ফোন করে বলল যে, সে তার বাল্যকাল থেকে শিখে এবং পালন করে আসা খ্রিস্টান ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হতে চায়।
এটা শুনে আমি যখন মেয়ের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সংবাদ আমার বয়স্ক বিধবা মাকে দিলাম তখন তিনি ভীত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘কী? মুসলিম?’
তিনি তখন ভেবে পাচ্ছিলেন না যে, আমাদের এই ছোট্ট পরিবারটিতে কিভাবে এক ছাদের নিচে দুই ধর্মের লোক বসবাস করবে!
হ্যাঁ, বাস্তবে আমরা সংগ্রাম করেছি। আমাদের বিভাজনকে পাশ কাটিয়ে ভালোবাসার যেসব শিক্ষা আমি খ্রিস্টান ধর্মে পেয়েছি তা আমি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। কাউকে নিয়ে কোনো বাজে ধারণা করা নয়, কোনো ভয় নয়, কপটতা নয়।
একজন সন্দেহভাজন ব্যাভিচারিনীকে পাথর মারতে উদ্যত লোকজনকে যিশু খ্রিস্ট কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, পাথর মারো যদি তুমি নিজে এমন পাপ না করে থাকো। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তাকেই প্রথম পাথরটি মারতে দাও যে এমন পাপ করেনি।’
অনেক ধর্মবেত্তা বলে থাকেন, তারপর যিশু মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে মানুষের কৃত এমন অনেক পাপের কথা লিখেছিলেন যেগুলোর জন্য তাদের ওপর পাথর মারা যায়।
কিছু মানুষ আছে যারা ইসলামভীতি প্রচার করে জীবন ধারণ করে থাকে। তারা ভুলে যায় যে যিশু কী বলে গিয়েছেন। দুনিয়াতে প্রকৃতপক্ষে ভালো কিছু করার এবং নিজের দিকে আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখার চেয়ে অন্যকে ঘৃণা আর সন্দেহ করা খুব সহজ কাজ।
কিছু দিন আগে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি আমার ধর্মগ্রন্থ বাইবেল রেখে মেয়ের ধর্মগ্রন্থ কোরআন পড়তে শুরু করেছি নাকি!
সত্যিই শুরু করেছি। তবে কুরআনের পুরোটা পড়া হয়নি। আমি বহু বছর ধরে চিন্তা করছিলাম যে, আমার বড় ব্যর্থতা হচ্ছে একটি গ্রন্থকে পবিত্র হিসেবে গ্রহণ করার কারণে আমার মেয়েকে কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে, অথচ এই কষ্ট তার প্রাপ্য নয়। আমি তার মা। যদি বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে একজন তার মায়ের কাছে খারাপ হয়ে যায় তাহলে বাকিদের কাছে তার কী অবস্থা হবে!
কিভাবে আমরা বর্তমানের ভয়, সন্দেহ আর উদ্বেগের সাথে লড়াই করবো? সেক্ষেত্রে ভালোবাসা একটা শক্তিশালী সমাধান হতে পারে। মেয়ের ধর্মান্তরিত হওয়া নিয়ে তার প্রতি অভিযোগের আংগুল তুলে আমি ঈশ্বরের দেয়া বহু বছর সময় নষ্ট করেছি, কিন্তু একবারও নিজের দিকে আংগুল তুলিনি।
ভালোবাসাতে কোনো ধর্মে বাধা নেই, বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। ধর্মতাত্ত্বিক এবং মানবাধিকার নেতা হাওয়ার্ড থ্রুম্যান বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘ভালোবাসার মানে হচ্ছে একজনের মনকে খোলা দরজার মতো বানিয়ে রাখা (যাতে সবাই ঢুকতে পারে)।’ কিছু দেয়া এবং কিছু গ্রহণ করা- এর নামই ভালোবাসা। এই ধরনের সাহসী পদক্ষেপ (একে অন্যকে ভালোবাসা) নিতে পারলে তার সামনে সন্ত্রাসবাদ টিকতে পারবে না।
[প্যাট্রিসিয়া রেবোন একজন অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী লেখিকা। তার সাম্প্রতিক বইটির নামে ‘আনডিভাইডে: অ্যা মুসলিম ডটার, হার ক্রিশ্চিয়ান মাদার, দেয়ার পাথ টু পীস’। মেয়ে এলেনা রেবোনকে সাথে নিয়ে বইটি লিখেছেন তিনি ।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button