শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে পিছনের সারিতে বাংলাদেশ
শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে পেছনের সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মারসারের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
গত বুধবার প্রকাশিত ‘দ্য হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট ২০১৫’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে ১২৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম। এছাড়া এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২২ দেশের মধ্যে ১৭তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের পরে রয়েছে বাংলাদেশ।
আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মধ্যে তাজিকিস্তান ও কম্বোডিয়ার পর বাংলাদেশের অবস্থান। ১০০ স্কোর ধরে পরিচালিত এ গবেষণায় বাংলাদেশের স্কোর ৫৭.৬২।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের ৮২ শতাংশ কর্মে নিয়োজিত থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ৬.৩ শতাংশ উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন। বাকিদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ আধা বা মাঝারি দক্ষ ও ৪০.৭ শতাংশ অদক্ষ। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে কর্মে নিয়োজিতের হার ৫৯ শতাংশ। এদের বহুমাত্রিক দক্ষতা তুলনামূলক কম। ৫৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের মধ্যে কর্মে নিয়োজিতের হার ৬৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি। মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশই অন্যের ওপর নির্ভরশীল, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে বা ৬৫ বছরের ওপর। কর্মক্ষম মানুষ ১০ কোটি ৬১ লাখ হলেও কাজের সঙ্গে যুক্ত এর মাত্র ৭১ শতাংশ। আর কর্মে নিয়োজিতের অধিকাংশই পুরুষ। নারীদের কর্মে নিয়োজিত থাকার হার পুরুষের তুলনায় ৪৪.৩ শতাংশ কম।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিজনেস স্কুলের মান মাঝারি ধরনের, যার স্কোর ৭-এর মধ্যে ৩.৭২। এ স্কোর গণিত বা বিজ্ঞানশিক্ষার ক্ষেত্রে ৩.৩৬, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণসেবায় ৩.১১, মেধা আকর্ষণ ক্ষমতায় ২.৪ ও মেধা ধরে রাখার ক্ষমতায় ২.৭১।
পেশার সঙ্গে শিক্ষার সামঞ্জস্যহীনতার চিত্রও উঠে এসেছে এ গবেষণায়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ৩ লাখ ১৬,০০০ শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এর মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও আইন বিষয়ে ১ লাখ ৩৫,০০০, মানবিক বিভাগে ১ লাখ ১০,০০০ ও বিজ্ঞান বিভাগে ৩৫,০০০। অথচ প্রকৌশল, উৎপাদন ও নির্মাণ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৪,০০০ ও স্বাস্থ্যসেবায় ৫,০০০ শিক্ষার্থী। বাকিরা অন্যান্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্তমানে ২০ লাখ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন। এর মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও আইনে ৯ লাখ ৬৯,০০০, মানবিক বিভাগে ৬ লাখ ৭,০০০ ও বিজ্ঞান বিভাগে ২ লাখ ৬৯,০০০। তবে প্রকৌশল, উৎপাদন ও নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ালেখা করছেন মাত্র ৬৫,০০০ ও স্বাস্থ্যসেবায় ৪৫,০০০। যদিও চাকরির বাজারে মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের চাহিদা কম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংযোগও সেভাবে নেই।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে শ্রীলঙ্কা। ৬৮.১৯ স্কোর নিয়ে দেশটির অবস্থান ৬০তম। ৬১.১১ স্কোর নিয়ে ভুটান রয়েছে ৮৭তম স্থানে। ৫৭.৬২ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের পরই রয়েছে ভারত, দেশটির অবস্থান ১০০তম। এছাড়া ৫৫.৭৭ স্কোর নিয়ে নেপাল ১০৬ ও ৫২.৬৩ স্কোর নিয়ে ১১৩তম স্থানে রয়েছে পাকিস্তান।
এদিকে, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে ফিনল্যান্ড। দেশটির স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৮৫.৭৮। ৮৩.৮৪ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় নরওয়ে, ৮৩.৫৮ নিয়ে তৃতীয় সুইজারল্যান্ড, ৮২.৮৮ স্কোরে চতুর্থ কানাডা ও ৮২.৭৪ স্কোর নিয়ে পঞ্চম জাপান।
শীর্ষ দশে এর পর রয়েছে যথাক্রমে- সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড ও বেলজিয়াম।
মূলত দুটি স্তম্ভের ভিত্তিতে সূচকটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো হলো শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। তবে প্রতি স্তম্ভের অধীনে কয়েকটি উপসূচক রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার, শিক্ষিতের হার, শিক্ষার গুণগত মান, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কাজ করতে গিয়ে শেখার হার।
আর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে রয়েছে কর্মক্ষম মানুষের চাকরিতে নিয়োজিতের হার, বেকারত্বের হার, আংশিক বেকারত্ব, দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব, দক্ষতা, শিশুদের কাজে নিয়োজিতের হার প্রভৃতি। প্রতি ক্ষেত্রেই খুবই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনটিতে পাঁচটি বয়সভিত্তিক শ্রেণী বিভাগে মানবসম্পদের দক্ষতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে দেশের বৃহৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, যাদের বয়স ২৫ থেকে ৫৪ বছর। সূচকটিতে বাংলাদেশের ২৫-৫৪ বছরের জনগোষ্ঠী দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বের ১২৪টি দেশের মধ্যে ১১১তম স্থানে রয়েছে। বয়সভিত্তিক অন্যান্য গ্রুপের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। এর মধ্যে ৫৫-৬৪ বছরের গ্রুপে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২তম, ১৫-২৪ বছরের গ্রুপে ৯১, ১৫ বছরের নিচের গ্রুপে ৮৯ এবং ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব গ্রুপে ৮৭তম।