অবশেষে গলছে পাষাণ হৃদয়

Ruhingyaকাউকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ নিজ দেশে জীবিকার সন্ধান করতে না পেরে বেরিয়েছিলেন ‘স্বপ্নের দেশে’ পাড়ি দিতে। এরপর সরকারি মদদপুষ্ট পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে সাগরে ভাসছেন মাসের পর মাস ধরে। ভাসমান নৌকায় খাবার নেই, পানি নেই। এ অবস্থায় ক্ষুধার্ত, অসুস্থ মানুষগুলো অজানার উদ্দেশে ভাসছে। তাদের আর্তনাদ কারো কানে ঢুকেনি এতদিন। দুঃসহ যন্ত্রণায় বহুসংখ্যক মারা গেছেন ইতোমধ্যে। তবে সর্বশেষ, একটু আশার আলো দেখা দিয়েছে কয়েকটি দেশের ঘোষণায়।
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এসব অভিবাসীকে সাময়িক আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। কিন্তু এখনো বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্রে ভাসমান থাকায় তাদের ভাগ্য নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তীরে ভিড়তে পারা সাড়ে ৩ হাজারের বাইরে অন্তত ৪ হাজার এখনো ভাসছে। তাদের কীভাবে উদ্ধার করা হবে তা নিয়ে দেশগুলোর কোনো বক্তব্য না থাকায় হতভাগা মানুষগুলো আর্তনাদ কি আদৌ থামবে তা এখনো সন্দেহের আবর্তে ঘুরছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে কোনো দেশের সরকার কর্ণপাত না করে থাকার পর অবশেষ গত মঙ্গলবার অভিবাসীদের আশ্রয়ের ব্যাপারে প্রথম ইতিবাচক মনোভাব দেখায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ফিলিপাইন। এরপর গতকাল বুধবার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে ভাসমানদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে সাময়িক আশ্বাস দিয়েছে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। অবশ্য কুয়ালামপুরের বৈঠক বর্জন করেছে মিয়ানমার।
এদিকে কারো আহ্বান ছাড়াই তুরস্ক ভাসমান মানুষদের উদ্ধার করতে নিজেদের একটি সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে বলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতুগ্লু জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার জাহাজটি রওয়ানা দিয়েছে।
অবশেষে আশার আলো: সাগরে ভাসতে থাকা অসহায় বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসন প্রত্যাশীদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। বুধবার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের অংশগ্রহণে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা। এর আগে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ড এসব সাগরভাসিদের আশ্রয় দেবে না বলে জানিয়েছিল। সাগরে কাঠের নৌকায় করে ভাসতে থাকা এসব লোকজন পানিতে পড়ে মারা গেলেও তাদের উদ্ধার না করার জন্য স্থানীয় জেলেদের নির্দেশ দিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ। এছাড়া রোহিঙ্গার অভিবাসী প্রত্যাশীদের দায় নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল মিয়ানমার। এসব ঘোষণার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিকভাবে কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে এশিয়ার এই দেশগুলো।
বুধবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় বৈঠক শেষে মালেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফা আমান বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ৭ হাজার অভিবাসী প্রত্যাশীকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দেবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় আগামী এক বছরের মধ্যে এসব আশ্রয় পাওয়াদের পুনর্বাসন এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হবে।’
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা অভিবাসী প্রত্যাশীদের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্যে মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে তিনি আরো বলেছেন, ‘যদিও এসব অভিবাসনে ইচ্ছুক এই সম্প্রদায়টি অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, তারপরও তাদের ভালোভাবে জীবনধারণের প্রচেষ্টাকে অগ্রাহ্য করা উচিত নয়।’ এদিকে আঞ্চলিক অভিবাসী সংকট সমাধানে প্রথমবারের মতো সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। এতদিন তারা এই সংকটের দায় অস্বীকার করে আসছিল।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে জানায়, আঞ্চলিক অভিবাসী সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের সঙ্গে একমত ইয়াঙ্গুন। সমুদ্রে যারাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, তাদের মানবিক সহায়তা দিতে মিয়ানমার প্রস্তুত। আঞ্চলিক অভিবাসী সংকটের দায় প্রশ্নে মিয়ানমার যে কিছুটা নমনীয় হয়েছে, দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতিটি সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এর আগে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, পোপ ফ্রান্সিস এবং ওয়াশিংটন রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অভিবাসী প্রত্যাসীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আরো ৪০০ বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা উদ্ধারকুয়ালালামপুরে তিনজাতি বৈঠক শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল বুধবার সকালে আরো ৩৭০ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে ইন্দোনেশিয়ান জেলেরা। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন নারী ও শিশু।
স্থানীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, আচেহ প্রদেশের মালাক্কা প্রণালি থেকে এসব অভিবাসীদের উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো সাগরে ভাসছে আরো ৪ হাজার অভিবাসী।
ইন্দোনেশিয়ার অনুসন্ধান ও উদ্ধার কর্মকর্তা খাইরুল নোভা জানিয়েছেন, উদ্ধারের পর অভিবাসীদের পূর্ব আচেহ জেলার শিমপাং তিগা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদ্ধারকারীদের একজন হলেন, উবায়দুল হক। তিনি সংবাদ সংস্থা এপিকে জানিয়েছেন, তাদের নৌকার ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকে তারা ৪ সপ্তাহ ধরে সাগরে ভাসছিলেন। দীর্ঘদিন সাগরে থাকার ফলে তারা পানিশূন্যতাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের খাবার দেয়া হয়েছে এবং আরামদায়ক পরিবেশে রাখা হয়েছে। পূর্ব আচেহ’র স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাতে ২৬ নারী এবং ৩১ শিশুসহ ১০২ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার সকালে তীরে নিয়ে আসা হয়েছে আরো ২৭২ জনকে।
এদিকে উদ্ধারকৃতরা জানিয়েছেন, নৌকায় খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার পর তারা মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে দেশের উপকূলে ভিড়তে দেয়া হয়নি। গত ১০ দিনে সাগর থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ড।
জাতিসংঘের বরাত দিয়ে টাইম ম্যাগাজিন জানিয়েছে, এখনো প্রায় ৪ হাজার মানুষ সাগরে ভাসমান রয়েছেন।
‘মানবিক সহায়তা’ দেবে মিয়ানমার: মিয়ানমার নৌকায় ভাসমান অভিবাসীদের মানবিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত বলে গতকাল বুধবার জানিয়েছে। এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ অঞ্চলটিতে উদ্ভূত এই সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনার জন্য বৈঠকে বসতে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার এ ঘোষণা দিল। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতোই ‘উদ্বিগ্ন’ এবং ‘সমুদ্রে ভাসমান মানুষের জন্য মানবিক সহায়তাদানে প্রস্তুত।’রোহিঙ্গাসহ কয়েক হাজার অভিবাসী মিয়ানমারের উপকূলে আটকে আছে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করে দেয়ার পর মিয়ানমারের এমন মন্তব্য পাওয়া গেল।
সামরিক জাহাজ পাঠাচ্ছে তুরস্ক: এদিকে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং বাংলাদেশি অভিবাসীদের উদ্ধারে সক্রিয় হয়েছে তুরস্ক। দেশটির নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ইতোমধ্যে আন্দামান সাগরের দিকে রওয়ানা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতুগ্লু। তিনি বলেন, আমাদের নৌবাহিনী ভাসমান লোকদের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করছে। মঙ্গলবার তরুণদের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর সহযোগিতায় ইতোমধ্যে একটি সামরিক জাহাজ রওয়ানা দিয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button