মুসলিম জাগরণে নজরুল সাহিত্যের অবদান
এমদাদুল হক চৌধুরী: ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত, ভারতবর্ষ থেকে দীর্ঘ প্রায় আটশ’ বছর শাসন করার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মুসলমানদের জীবনে এক কঠিন সংকটময় সময় আবির্ভূত হয়। জাতীয় জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। জাতি তার গন্তব্যপথ নিরূপণ করতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, নৈরাশ্যের শিকার হয়। ফলে ধীরে ধীরে ভয়াবহ নির্জীবতা তাকে গ্রাস করে। সে অন্যায় দেখে কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারে না, সে তার বন্দীত্বকে অনুভব করে কিন্তু তা থেকে মুক্ত হওয়ার মত শক্তি খুঁজে পায় না। বিশেষ করে সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে রাজরোষে দগ্ধ হতে থাকলো ভারতবর্ষের মুসলমানরা। নির্যাতনের চরম স্টীম রোলার চলল মুসলমানদের উপর। বঞ্চিত, অবহেলিত, উৎপীড়িত মুসলমানদের অক্ষম ক্ষোভ, রোষে বেদনায় জ্বলতে থাকলো, পুড়তে লাগলো। কিন্তু এই উৎপীড়ন ও অন্যায় আচরণ ও নিষ্ঠুর অবহেলাই বহন করে নিয়ে এলো নতুন উত্থানের বীজ।
নজরুল স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলিম সমাজকে জাগাতে হলে আঘাত দিয়েই জাগাতে হবে। তাই নজরুল ১৯৩২ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন :
“পথপার্শ্বের যে অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম; ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদের মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। খোদার দেওয়া এই পৃথিবীর নিয়ামত হইতে যে নিজেকে বঞ্চিত করিল, সে যত মুনাজাতই করুক, খোদা তাহা কখনই কবুল করিবেন না। খোদা হাত দিয়াছেন বেহেশতী চীজ বরণ করিয়া লইবার জন্য, ভিখারীর মতো হাত তুলিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়।”
নজরুল “সত্যবাণী” প্রবন্ধে আরো বলেছিলেনÑ
“ইসলাম ঘুমাইবার ধর্ম নয়, ইসলাম ভিক্ষা করে না, যাঞ্চা করে না।” আমাদের বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে যে গোঁড়ামী, যে কুসংস্কার, তাহা পৃথিবীর আর কোনো দেশে, কোনো মুসলমানদের মধ্যে নাই বলিলে বোধ হয় অতুক্তি হইবে না।
নজরুল মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন একদল প্রগতিশীল যুবক, যারা পোশাকী ইসলাম পরিত্যাগ করে, ইসলামের মর্মবাণী উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। প্রগতিশীল বিদ্রোহীর উদ্ভব না হলে এর চেতনা আসবে না। নজরুল আক্ষেপ করে বলেছিলেন:
“কারো গান থেকে এতটুকু চুন খসবে না, গায়ে আঁচড়টি লাগবে না, তেল কুচ-কুচে, নাদুস-নুদুস ভূঁড়িও বাড়বে এবং সমাজও সাথে সাথে জাগতে থাকবে-এ আশা আলেম সমাজ করতে পারেন, আমরা অবিশ্বাসীর দল করিনে।”
ইসলামের প্রতীক নওজোয়ানী, বার্ধক্য নয়। মুসলিমের জান্নাতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রবেশাধিকার নেই। তাই নজরুল আজানের আহ্বান শুনতে নওজোয়ানকে ডাক দিয়ে বিশ্ব মুসলিমদের উদ্দেশ্যে গেয়ে উঠেনÑ
বাজিছে দামামা, বাঁধ রে আমামা,
শির উঁচু করি মুসলমান!
দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার;
ভাঙাকিল্লায় ওড়ে নিশান।
মুখেতে কল্মা, হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার;
হৃদয়ে লইয়া এশ্ক আল্লার
চলো আগে চলো বাজে বিষাণ।
ভয় নাই তোর গলায় তাবীজ
বাঁধা আছে যে রে পাক কোরআন।
নজরুল যেন একপ্রকার জবরদস্তি করে বাঙালী মুসলমানদের ভেতর একটা জলন্ত দীপশিখা মতো অনিবার্য প্রাণ ঢুকিয়ে দিয়ে বলেন-
তাজা-বতাজার গাহিয়া গান
সজীব করিব গোরস্তান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ,
বাহুতে নবীন বল”
গোরস্তানেই নজরুল আশ্চর্য প্রাণের মজলিশ বসিয়েছেন। মৃতপ্রায় মুসলিম শক্তিতে জাগাতে তিনি নবীনদের আহ্বান জানালেন। মুসলমানদের অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে নজরুল গেয়ে উঠলেন-
আল্লাহ্তে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান
কোথা সে আরিফ, অভেদ যাঁহার জীবন মৃত্যু জ্ঞান।
যার মুখে শুনি তৌহীদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম
যাঁর দীন দীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জিন পরীÑইনসান।
নজরুলই ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দিলেন, কুরআন এসেছে মুসলমাদের বিশ্ব দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করে দিতে। তাঁদের পূর্ব-পুরুষেরা ঈমানের বলে এমনি বলিয়ান হয়েছিল যে, মুত্যৃও ভয়ে সালাম করতো।
তৎকালীন সময়ে মুসলিম সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদরা নজরুলকে বিপুল সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে দেখেছিলেন। ঘুমন্ত ও মৃতপ্রায় মুসলিম সমাজকে জাগাতেই বোধ হয় আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নজরুলের আবির্ভাব। প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর চিঠিতে সে আশারই প্রতিধ্বনী শোনা যায়। নজরুলকে লেখা প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:
ভাই নজরুল,
“……….. বাংলার মুসলমান সমাজ কাঙ্গাল, শুধু ধনে নয়, মনেও। সমাজ মরতে বসেছে। তাকে বাঁচাতে হলে চাই সঞ্জীবনী সুধাকে সেই সুধার পাত্র হাতে এনে এই মরন্মোমুখ সমাজের সামনে দাঁড়াবে’কে জানি না; কিন্তু মনে হয় তোমায় বুঝি খোদা সে সুধা ভান্ডের কিঞ্চিত দা করেছেন, অন্তরের অন্তরালে বুঝি সে সাধনার বীজ জমা আছে।
বাঙালী মুসলিম চেয়ে আছে তোমার কণ্ঠে দিয়ে ইসলামের প্রাণবাণী পুনঃপ্রতিধ্বনিত হবে, ইসরাফিলের শিঙ্গার মত সেই প্রতিধ্বনি এই নিদ্রিত সমাজকে মহা আহ্বানে জাগ্রত করবে।
বাংলার মৌলানা রুমীর আসন খালি পড়ে আছে। তুমি তাই দখল করে ধন্য হও, বাংলার মুসলিমকে বাংলার সাহিত্যকে ধন্য করো।”
নজরুল তাঁদের আকাক্সক্ষা ও দাবী পূরণে চেষ্টা করেছেন। নজরুল ইসলাম তাঁর অজস্র ইসলামী গান ও গজলের মধ্য দিয়ে সেদিনের মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রনায়কের কাজ করেছিলেন। সেসব গান কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত, পল্লীবাসী, নগরবাসী সব বাঙালী মুসলমানের মনে অভূতপূর্ব সাড়া তুলেছিল।
আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে নজরুল ইসলামী গান শুনে বাংলার মুসলমান একটি আকাক্সিক্ষত, বহু প্রতীক্ষিত বস্তুর রস আস্বাদন করলো। নজরুল লিখলেন :
ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশীর ঈদ।
তিনি আরো গাইলেন-
দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠিছে
দ্বীন-ই ইসলামী লাল মশাল
ওরে বে-খবর তুইও ওঠ জেগে
তুইও তোর প্রাণ-প্রদীপ জ্বালা।
আরো লিখলেন
আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে কভু শির করিও না নীচু
এক আল্লাহ্ ছাড়া কাহারোও বান্দা হবে না বল
দেখিবে তোমার প্রতাপে পৃথিবী করিতেছে টলমল।
আরো গাইলেন
বক্ষে আমার কাবার ছবি
চক্ষে মোহাম্মদ রসূল,
শিরোপরি মোর খোদার আরশ,
গাই তারি গান পথ বেভুল!
তিনি লিখলেনÑ
নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম মোহাম্মদ বোল,
যে নাম নিয়ে চাঁদ সেতারা আসমানে খায় দোল।
নজরুল মুসলিম জাতির ধ্যান ভাঙানোর জন্য লিখলেন-
ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি।
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি-
আমরা সেই সে জাতি।
পাপ বিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা
মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙাড়ি শীতল শান্তিধারা
উচ্চ নীচের ভেদভাঙি দিল সবারে বক্ষপাতি
আমরা সেই সে জাতি।
তিনি আরো গাইলেন-
ভুবন জয়ী তোরা কি হায়, সেই মুসলমান।
খোদার রাহে আনল যারা দুনিয়ানা ফরমান॥
এশিয়া য়ুরোপ আফ্রিকাতে যাহাদের তকবীর
ডঙ্কারিল, উড়ল যাদের বিজয় নিশান॥
ইসলাম এসেছে মানবতার মুক্তির জন্য, যেখানে মানবতা নিষ্পেষিত, রাহগস্ত, সেখানেই ইসলাম, ইসলাম সকল জুলুম-অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে।
নজরুল আমাদের প্রেরণার কবি, স্বপ্নের কবি, জাতীয় কবি। এই কবি স্বার্থপরতার সমস্ত মোহ ত্যাগ করে একটি ঘুমন্ত ও মুমুর্ষু জাতিকে জাগাবার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন, একাই যুদ্ধ করেছেন বিশাল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে।