কোরআনের শিল্পী কারি উবায়দুল্লাহ ভালো নেই
তোফায়েল গাজালি: কুদরতি সৃষ্টির সুরে একদিন নেচে উঠেছিল খোদার আরশ কুরসি। জেগে উঠেছিল মানুষের মৃত আত্মাগুলো। সজীব ও সতেজ হয়ে উঠেছিল উত্তপ্ত পৃথিবীর শুষ্ক প্রকৃতি। জিবরাইলের হাতের বাঁশিতে সুর ফুঁকেছিলেন মোহাম্মদ (স:)। সেদিন বাঁশির সুরে টান দিয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক/খালাকাল ইনসানা মিন আলাক’। প্রেমময়ের সেই সুর আরব উপদ্বীপ পাড়ি দিয়ে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। সেই সুরের মন্ত্রমুগ্ধ লহরিই বেসামাল ওয়াস কোরনিকে নবীর প্রেমে সবকটি দাঁত ভেঙে ফেলতে বাধ্য করেছিল। সৈন্য-সামন্ত আর ধনভাণ্ডারে ভরপুর ইবরাহীম আদহামকে নিয়ে গিয়েছিল বনে-জঙ্গলে। রাবেয়া বসরী, হাসান বসরী, জোনায়েদ বোগদাদী, আবদুল কাদির জিলানি, খাজা মঈন উদ্দীন চিশতিকে ওই সুরই বেকারার করে রেখেছিল শেষদিন পর্যন্ত। একদিন হেরার সে সুর বেজে উঠল সবুজভূমি বাংলাদেশে। ১২ আউলিয়ার পাক জমিন ইসলামাবাদের (চট্টগ্রামের) রাঙ্গুনিয়ায় জন্ম নিলেন ইসলামের রাঙ্গাদুলাল উবায়দুল্লাহ।
১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি। নতুন পৃথিবীর নতুন সুরে বিস্মিত উবায়দুল্লাহ আচ্ছন্ন হয়ে শুনলেন কানে ফুঁকে দেয়া আজান ধ্বনির সত্যের আহ্বান। যেন সিদ্ধান্ত নিলেন- এই সুর দিয়েই বিশ্ব জয় করার। আজান ধ্বনি থেকেই অ্যাসাইনমেন্ট বুঝে নিলেন পৃথিবীর পথচলার। একদিন মায়ের কোলে বসে বাবার হাতেই নিলেন সুরের হাতেখড়ি। আউযু… বিসমিল্লাহ, তারপর একদিন সুরের ভুবনে প্রবেশ করলেন উবায়দুল্লাহ। মহল্লার মসজিদ, আশপাশ এলাকার মাহফিল, উৎসব-পার্বণ, সমাবেশ-সম্মেলন, নানা উদ্বোধন কিছুই যেন এখন আর উবায়দুল্লাহ ছাড়া চলে না। সেদিনের ছোট্ট বালক উবায়দুল্লাহ আজ কারি উবায়দুল্লাহ। ধীরে ধীরে গ্রামগঞ্জ ছাড়িয়ে শহর-বন্দর সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়তে লাগল কারি উবায়দুল্লাহর সুর। মোহাম্মদ (সা.)-এর রেখে যাওয়া বাঁশিতে যেন বহুকাল পরে আবার সুর ওঠল। কোরআনের সুরে জেগে উঠল পৃথিবী, হেসে উঠল খোদার সব সৃষ্টি। ১৯৬২-এর এক মাহেন্দ্রক্ষণে রেডিও পাকিস্তানে হৃদয়ের সব সুর মিশিয়ে সূরা ফাতেহায় টান দিলেন সুরের জাদুকর কারি উবায়দুল্লাহ। ঐশী সুরের মায়াবি টানে নড়ে উঠল অসংখ্য সুরহারা মুসলমান। তাই তো তৎকালীন পাকিস্তানের বহু মানুষ প্রতিদিন ফজরের পর বা সকাল ৬টা সাড়ে ৬টায় কান পেতে বসে যেতেন রেডিও হাতে। কারি উবায়দুল্লাহর কণ্ঠে ‘ফাবিআইয়ি আলা ইরাব্বিকুমা তুকাযযিবান’-এর মতো সুরময় কোরআনের নানা ছন্দে নিজের সারা দিনটিকে রাঙিয়ে নিতে। রেডিও পাকিস্তান বা ১৯৬৫ সালে শুরু হওয়া পাকিস্তান টেলিভিশন যত দিন ছিল ততদিন কারি উবায়দুল্লাহ কোরআনের সুর দিয়েই মাতিয়ে রেখেছিলেন হাজার হাজার প্রাণ।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বেতারে প্রথম যে সুর ধ্বনি বেজে উঠল সেও কারি উবায়দুল্লাহর কণ্ঠে ‘জালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিহ’। ১৯৭৫ সালে বিটিভি যার তেলাওয়াতের মাধ্যমে উদ্বোধন হল তিনিও কারি উবায়দুল্লাহ। বাংলাদেশ পার্লামেন্টের সেই শুরুর অধিবেশন থেকে ৯ম পার্লামেন্ট পর্যন্ত আমাদের জাতীয় সংসদকেও কোরআনের মধুর সুরে মুখরিত করে রেখেছিলেন তিনি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, নিউমার্কেট, হোটেল শেরাটনসহ জাতীয় অসংখ্য স্থাপনার উদ্বোধন হয়েছে তার তেলাওয়াতের মাধ্যমে। কারি উবায়দুল্লাহ সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, লিবিয়া, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্তত ২০-২৫টি দেশে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বারবার ১ম স্থান অর্জন করে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনেন বিরল মর্যাদা। যথাক্রমে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল ও খালেদ দুইবার তাকে কোরআনের শিল্পী বা কারি হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন। কারি উবায়দুল্লাহর সুমধুর তেলাওয়াত বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও প্রায় জুমাবার টেনে নিয়ে আসত চকবাজার শাহী মসজিদে। নামাজের পর বঙ্গবন্ধু কারি উবায়দুল্লাহর বুকে বুক লাগিয়ে নিজের অন্তরাত্মায় আলো সিঞ্চন করতেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন কারি উবায়দুল্লাহর ছাত্র। তিনি দীর্ঘদিন তার কাছে কোরআন শিক্ষা করেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মেজর জিয়া কখনও কখনও শুধু কোরআনের সুর শোনার জন্য তাকে বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসতেন। আজও বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে মিষ্টস্বরে হৃদয়গ্রাহী যে আজান ধ্বনি প্রচারিত হয় সেটিও কারি উবায়দুল্লাহর কণ্ঠে।
এতসব কৃতিত্বের অধিকারী কারি উবায়দুল্লাহ আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দীর্ঘ ৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি অসুস্থ। ৬ বার ব্রেইন স্ট্রোক ও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে আজ যেন বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে আছেন এ সুরের কারিগর। একদিন যে সুর দিয়ে গোটা পৃথিবীকে মাতিয়ে ছিলেন আজ আর সেই সুর নেই তার কণ্ঠে। কথা বলেন হাতের ইশারা-ইঙ্গিতে। লালবাগের যে বাড়িতে তিনি বসবাস করতেন ভাগ্য তাকে সেই বাড়ি থেকেও বের করে দিয়েছে ৫-৬ বছর আগে। কামরাঙ্গীরচরের এক জীর্ণ কুটিরে আজ তার আশ্রয়। তাবিজ-কবচ আর দোয়া-দরূদে বিশ্বাসী কিছু মানুষ ছাড়া কালেভদ্রেও কেউ তাকে স্মরণ করে না। সুদিনের অনেক ভক্তও জানেন না আজ কোথায় তিনি? জীবিত না মৃত? তাই কারি উবায়দুল্লাহর ঠিকানা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হল আমাদের। প্রযুক্তির ডানায় ভর করে খুঁজে না পেয়ে তথ্যের ভিত্তিতে বন্ধু সুহাইলকে নিয়ে হেঁটে ঘুরলাম মৃত বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী আশরাফাবাদ থেকে মাতবর বাজারের প্রতিটি গলি। শেষে মাতবর বাজারের প্রথম দিকে কলকারখানায় বেষ্টিত এক বাড়িতে তার খোঁজ পেলাম। বিশ্রী ধোঁয়া আর কেমিক্যালের অসহ্য দুর্গন্ধ মাড়িয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই হাতের ইশারায় কারি উবায়দুল্লাহ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। কারির স্ত্রীর কাছে আমাদের পরিচয় দিয়ে তার বর্তমান অবস্থা শুনতে চাইলাম। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কারি তার হাতের লাঠি দিয়ে জোরে জোরে মেঝেতে আঘাত করতে লাগলেন। মুখ দিয়ে গুঙ্গিয়ে গুঙ্গিয়ে বিরক্তির ভাব নিয়ে কি যেন বলতে লাগলেন। এ আঘাত আর গুঙ্গানোর ব্যাখ্যা করলেন তার স্ত্রী এভাবে- ‘আগেও বহু সাংবাদিক আইচে, বিডিও কইরাবি নিছে, মগর কই কিছু তো ওহে নাইক্কা, কেউই তো বি খবর নেয় না, আমগো আল্লাহ আছে, কারিসাব সারা জীবন আল্লাহর কাম করছে আল্লাহ তার খবর নিছে’। তিনি মনের ক্ষোভে এখন আর মিডিয়ায় আসতে চান না। যেভাবে হোক স্ত্রী তাকে ম্যানেজ করলে আমরা বসে রইলাম তার পাশে। বেশ কিছু সময় পর হামাগুড়ি দিয়ে বাংলাদেশ বেতারের এক স্মরণিকায় প্রকাশিত তার একটি সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন দেশে কেরাত পড়া অবস্থায় তোলা কটি ছবি আমাদের দেখালেন। অনেক্ষণ খুঁজে একটি বায়োডাটাও আমাদের দিলেন। আকস্মিক কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কেরাত মাহফিলের স্টেজের একটি ছবি দেখিয়ে মনে হয় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমাদের কিছু বলতে চাইলেন। বলতে না পেরে গুমরে গুমরে কাঁদলেন, আমাদেরও কাঁদালেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে ভাবলাম। হায় মুসলমান! হায় বাংলাদেশ! হায়রে মানুষ! এদেশেই তো কোনো নায়িকা-গায়িকার গলায় সামান্য কাঁটা ফুটলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় গলার কাঁটা তোলা হয়। এদেশে যদু-মধুদেরকেও তো রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষ পদকে ভূষিত করা হয়। লুটেরা-দুর্নীতিবাজরাও তো সব রকমের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে। কিন্তু আফসোস! মুসলমানের দেশে কোরআন ও কোরআনের সেবকদের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না! যে কারি উবায়দুল্লাহ ছাড়া সংসদের একটি অধিবেশনও শুরু হতো না, যে কারি উবায়দুল্লাহর তেলাওয়াত না শুনলে বঙ্গবন্ধু বা শহীদ জিয়ার আত্মা শান্তি পেত না, বঙ্গবন্ধু আর শহীদ জিয়ার অনুসারী কেউই কি আজ তার খোঁজ রাখেন? যে মানুষটি সারা জীবন কোরআনের আলো দিয়ে দেশ ও মানুষকে পথ দেখালেন- এই দেশের এ মানুষগুলোর কাছে তার কি কোনো পাওনা নেই? এ দেশের কর্তাব্যক্তিরা কি তার হাতে ন্যূনতম একটি সম্মাননা সনদও উঠিয়ে দিতে পারেন না? অন্তত তার মৌলিক প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কি আমাদের নয়? হায়! এদেশে কি আজ আর কোরআনের সত্যিকার কোনো প্রেমিক নেই? যারা জীবন্ত এই কোরআন বেত্তাকে যথাযথ সম্মান দেবেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! বিরোধীদলীয় নেত্রী! আপনারা তো কত মানুষের জন্যই কত কিছু করেন! কারি উবায়দুল্লাহর কাছে একটু আসুন না! অন্তত তার জীবনের এ অন্তিম সময়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে কোরআনপ্রেমী বাংলাদেশী মুসলমানদের কিছুটা হলেও দায়মুক্ত করুন প্লিজ!