এফবিসিসিআই নির্বাচন : মাতলুব আহমাদের প্যানেল ১২টি পদে জয়ী
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পার্লামেন্ট হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নির্বাচনে উন্নয়ন পরিষদ বিজয়ের পথে রয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদের নেতৃত্বাধীন প্যানেলের অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের অধিকাংশ প্রার্থী এগিয়ে ছিলেন। গণনা সম্পন্ন হওয়া চেম্বার গ্রুপে মাতলুবের উন্নয়ন পরিষদ থেকে ১২ জন প্রার্থী বিজয়ী হন। দলনেতা মনোয়ারা হাকিম আলীসহ স্বাধীনতা ব্যবসায়ী পরিষদ থেকে বিজয়ী হয়েছেন চারজন পরিচালক।
উন্নয়ন পরিষদের বিজয়ী প্রার্থীরা হলেন- নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের আলহাজ বজলুর রহমান, নরসিংদী চেম্বারের প্রবীর কুমার সাহা, বাংলাদেশ ওমেন চেম্বারের হাসিনা নেওয়াজ, মেহেরপুর চেম্বারের নাগিবুল ইসলাম দিপু, গোপালগঞ্জ চেম্বারের শেখ ফজলে ফাহিম, ময়মনসিংহ চেম্বারের আমিনুল হক শামীম, কিশোরগঞ্জ চেম্বারের গাজী গোলাম আসরিয়া, সুনামগঞ্জ চেম্বারের নূরুল হুদা মুকুট, বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বারের নিজাম উদ্দিন, চুয়াডাঙ্গা চেম্বারের দীলিপ কুমার আগরওয়াল, গাজীপুর চেম্বারের আনোয়ার সাদত সরকার ও জামালপুর চেম্বারের রেজাউল করিম রেজনু।
এ ছাড়া স্বাধীনতা ব্যবসায়ী পরিষদের বিজয়ী পরিচালকরা হলেন- দলনেতা মনোয়ারা হাকিম আলী, মানিকগঞ্জ চেম্বারের তাবারাকুল তোসাদ্দেক হোসেন খান টিটু, কুমিল্লা চেম্বারের মাসুদ পারভেজ খান (ইমরান) এবং যৌথভাবে কোহিনুর ইসলাম ও মো: মাসুদ। কোহিনুর ইসলাম ও মো: মাসুদ দুজনই ২০৫ ভোট পেয়েছেন। এ দু’জনের বিষয়ে ভোট পুনঃগণনা করে পরে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী আশরাফ। চেম্বার গ্রুপে সর্বোচ্চ ৩৩৫ ভোট পেয়েছেন উন্নয়ন পরিষদের আমিনুল হক শামীম।
ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়া এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলে শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। চেম্বার গ্রুপে ৪৩৬ ভোটের মধ্যে পড়েছে ৪১৮টি। অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপে এক হাজার ৭৬৮ জনের মধ্যে ভোট দিয়েছেন এক হাজার ৫৩২ জন। সর্বিকভাবে ভোট পড়েছে ৮৮ শতাংশের মতো। ভোটগ্রহণের ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকে অনিয়মের তেমন কোনো অভিযোগ পাওয়া না গেলেও সরকার দলের সমর্থক ব্যবসায়ীদের অযাচিত প্রভাব বিস্তারের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক প্রার্থী ও ভোটার।
ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ এ সংস্থার নির্বাচনে ব্যাপক অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ ভোটাররা। প্রচণ্ড গরমে ভিড় ও দীর্ঘ সরু পথ অতিক্রম করে ফেডারেশন ভবনের আট তলায় উঠে ভোট দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কয়েকজন ভোটার। অনেকে বাড়ি ফিরে গেছেন ভোটাধিকার প্রয়োগ না করেই। ঘটেছে অবাধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং হাতাহাতির ঘটনাও। যদিও সব পক্ষই ফলাফল মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
নানা বিশৃঙ্খলা আর অব্যবস্থাপনা ল করা গেছে ভোটগ্রহণের শুরু থেকেই। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এক পক্ষের সমর্থকদের মিছিল করা, বিপুল সংখ্যক নির্বাচনী কর্মীর উপস্থিতিতে প্রচণ্ড ভিড়ের সৃষ্টি হওয়া, ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা, ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বিড়ম্বনাসহ নানা ঝামেলা পোহাতে হয় ভোটারদের। এসব ব্যাপারে নির্বাচন বোর্ড থেকে পুলিশকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গতকালের নির্বাচনে চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের নির্বাচিত ৩২ পরিচালক পদের বিপরীতে ৩টি প্যানেলে ৬৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে মাতলুব আহমাদের নেতৃত্বাধীন ‘উন্নয়ন পরিষদ’ থেকে ৩২ জন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান প্রথম সহসভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলীর নেতৃত্বাধীন চেম্বার গ্রুপ ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়ী পরিষদ’ থেকে ১৫ জন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ড. কাজী এরতেজা হাসানের নেতৃত্বাধীন ‘ব্যবসায়ী ঐক্যপরিষদ’ থেকে ১৬ জন এবং জাকিয়া সুলতানা মিথিলা নামে একমাত্র স্বতন্ত্র প্রার্র্থী অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে নির্বাচন করেন।
ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ এ নির্বাচনে সভাপতি পদপ্রার্থী হলেও গতকালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন না। কারণ তিনি এর আগে রাজশাহী চেম্বার থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিচালক মনোনীত হয়ে এসেছেন। সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন ফেডারেশনের বর্তমান প্রথম সহসভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলীও। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৩২ জন এবং এর আগে বড় চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন থেকে মনোনীত হয়ে আসা ২০ জন পরিচালক ভোট দিয়ে আগামীকাল সোমবার তাদের মধ্য থেকে একজন সভাপতি, প্রথম সহসভাপতি ও সহসভাপতি মনোনীত করবেন।
নিয়ম অনুযায়ী এবার সভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচিত হবেন চেম্বার গ্রুপ থেকে। অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হবেন প্রথম সহসভাপতি। নির্বাচনী দৌড়ে এগিয়ে থাকা ‘উন্নয়ন পরিষদ’ ইতোমধ্যে আবদুল মাতলুব আহমাদকে সভাপতি, হেলাল উদ্দিনকে প্রথম সহসভাপতি ও বজলুর রহমানকে সহসভাপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। বড় ধরনের কোনো অঘটন না ঘটলে এই তিনজনই আগামী দুই বছরের জন্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সর্বোচ্চ এ ফেরামে নেতৃত্ব দেবেন। যদিও সরকারি দলের নেজুড়বৃত্তির কারণে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠন ইতোমধ্যেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। বাকি আছে কেবল পদপদবি আর সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য স্বার্থের লড়াই।
বিকেল সোয়া ৫টায় সাংবাদিকদের ব্রিফিং দেন নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক আলী আশরাফ এমপি। তিনি বলেন, সকাল বেলায় একটু উত্তেজনা দেখা দিলেও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। প্রায় ৯৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। যদিও চূড়ান্ত হিসেবে দেখা যায় ভোট পড়েছে ৮৮ শতাংশের কিছু বেশি। ভোট দিতে এসে অব্যস্থাপনার শিকার হয়ে কিছু ভোটারের ফেরত যাওয়া এবং কয়েকজনের অসুস্থ হয়ে পড়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী আশরাফ বলেন, ছোট জায়গায় ভোট গ্রহণের ফলে ভোটারদের ভোগান্তি হয়েছে এটা সত্য। রোদ-গরমের মধ্যে তাদের বেশ কষ্ট হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ আয়োজন করব। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তবে আগামীতে যাতে আরো বড় পরিসরে ভোটগ্রহণ করা যায় সে উদ্যোগ নেয়া হবে।
এর আগে ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে মন্তব্য করে ব্যবসায়ী উন্নয়ন পরিষদের দলনেতা আবদুল মাতলুব আহমাদ সাংবাদিকদের বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ইচ্ছার জাগরণ হয়েছে। বিশাল অংশ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে যোগ্য ব্যবসায়ী নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। ঘোষণা দেন, ফলাফল যাই হোক মেনে নেবেন।
একই ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা ব্যবসায়ী পরিষদের প্যানেল লিডার মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষায় কাজ করবেন।
অপর দিকে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, নির্বাচন না করতে নানামুখি চাপ ছিল। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার অফার দিয়েছিল। ওই লোভে না পড়ে স্বচ্ছতার স্বার্থে ভিন্ন প্যানেল নিয়ে নির্বাচন করেছি। আমরা পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে প্যানেল দিয়েছি। হারজিত যা হয়, মেনে নেবো।