ইসলামী ব্যাংকিং : ন্যায়ভিত্তিক এক অনন্য ব্যাংকব্যবস্থা
ইকবাল কবীর মোহন: বিগত ২রা ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় একটা খবরের ওপর চোখ পড়তেই অবাক হলাম। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ইসলামী ব্যাংকিং, সুদ ও রিবা সম্পর্কে একটি স্পর্শকাতর মন্তব্য করেছেন। মন্ত্রী মহোদয় যা বলেছেন তা সংক্ষেপে এরূপ : ‘ইসলামী ব্যাংকিং একান্তই একটি ফ্রড। – যারা ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলেন, তারা সুদ ও রিবাকে এক করে ফেলেন। ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। রিবা আর বর্তমান সুদ এক জিনিস নয়।’ একজন সংসদ সদস্যের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথাগুলো বলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচটি বাংলা দৈনিকের পাঠক। স্বভাবতই অন্য চারটি পত্রিকায় চোখ বুলালাম। একই খবর দেখলাম ঐসব পত্রিকায়ও। তবে প্রকাশের ভাষা ও বাক্য গঠনের ধরন ভিন্ন হলেও ইসলামী ব্যাংক, সুদ ও রিবা নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। এরপর থেকে এ বিষয়টি নিয়ে অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন এবং এর সত্যতা নিয়ে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সবার প্রশ্ন একটাই। মন্ত্রী মহোদয়ের মন্তব্য কী ঠিক? ব্যাপারটা আসলে কী? ‘রিবা’ যা ‘সুদ’ সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য স্পষ্ট। একটি ধর্মীয় বিধানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক। অথচ এসব বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের এমন মন্তব্যের কারণ কী? বিষয়টি পাঠকের কাছে স্পষ্ট করার তাগিদ থেকেই আমার আজকের এই লেখা।
সুদ ও রিবা কি আলাদা?
অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ইসলামে ‘রিবা’ নিষিদ্ধ। কিন্তু রিবা ও সুদ এক নয়। তার মানে আধুনিক পরিভাষা ‘সুদ’ বা ‘ইন্টারেস্ট’ এক জিনিস। আর আল-কুরআনে বর্ণিত ‘রিবা’ তার থেকে আলাদা। তিনি আরো বলেছেন, ‘রিবা’ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। তাই রিবায় কোনো মানবিকতা নেই। সুদ হচ্ছে ‘তহবিলের ব্যয়’ (কস্ট অব ফান্ড) বা ‘প্রশাসনিক খরচ’ (কস্ট অব এ্যাডমিনিস্ট্রেশন)। আমি যতটুকু পড়াশোনা করেছি তার ভিত্তিতে বলতে পারি ‘রিবা’ ও ‘সুদ’ সম্পর্কে এমন বক্তব্য সঠিক নয়।
‘রিবা’র আভিধানিক অর্থ হলো বৃদ্ধি, আধিক্য, অতিরিক্ত, স্ফীত, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। ঋণের বিপরীতে সময়ের সাথে যে কোনো বৃদ্ধিই হচ্ছে ‘রিবা’। ‘সুদ’ শব্দটি ফারসি থেকে এসেছে। কুরআনে ব্যবহৃত ‘রিবা’ শব্দের অর্থ ফারসিতে ‘সুদ’। সুদকে ইংরেজিতে ইউঝারি (Usury) বা ইন্টারেস্ট (Interest) বলা হয়। Oxford Advanced Learners Dictionary- তে Interest বলতে টাকা ধার করার কারণে তার উপর টাকা ধার্য করা বুঝায়। আর Usury বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে, Interest ও Usury দুটোর অর্থই ‘সুদ’। তবে তফাত হলো, অতি উচ্চহারের সুদ (Compound Interest) বুঝাতে ইংরেজি Usury, আর সরল সুদ (Simple Interest) বুঝাতে Interest শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তবে আল-কুরআনে উচ্চহার ও নিম্নহার বুঝাতে কোনো আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। কুরআনে ‘সুদ’ বলতে কেবল ‘রিবা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘রিবা’ অর্থ কেবল চক্রবৃদ্ধি সুদ নয়। চক্রবৃদ্ধিকে আরবি ভাষায় ‘রিবা’ বলা হয় না। চক্রবৃদ্ধিকে আরবিতে বলা হয় ‘আদ’আফাম মুদা’আফা’। সূরা আল-ইমরানের ১৩০ নাম্বার আয়াতে ‘রিবা’ শব্দটি যেমন আছে, এবং ‘আদ’আফাম মুদা’আফা’। সূরা আল-ইমরানের ১৩০ নাম্বার আয়াতে ‘রিবা’ শব্দটি যেমন আছে, এবং ‘আদ’আফাম মুদা’আফা’ শব্দটিও আছে। অর্থাৎ একই আয়াতে ‘রিবা’ দিয়ে সুদ আর ‘আদ’আফাম মুদা’আফা’ দিয়ে চক্রবৃদ্ধি বুঝানো হয়েছে। অতএব, ‘রিবা’ বলতে কেবল চক্রবৃদ্ধি সুদ বুঝায় না। বরং ইসলামে যা ‘রিবা’ প্রচলিত ব্যাংকিং-এ চালু ‘সুদ’ একই। ‘সুদ’ ও ‘রিবা’র মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ‘রিবা বলতে উচ্চহার, নি¤œহার, চক্রবৃদ্ধি, ভোগ্যঋণের সুদ, উৎপাদন ব্যয়ের সুদ, পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সুদসহ সব ধরনের সুদকে বুঝায়। আর ইসলামে সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদ উভয়ই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সূরা আল-বাকারার ২৭৬ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন।’ আর সূরা আলে-ইমরানের ১৩০ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা দ্বিগুণ-বহুগুণে সুদ খেয়ো না।’ অতএব, রিবা শুধু চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে এ কথা বলার কোনো যুক্তি নেই।
সুদ মানবিক আর রিবা কি অমানবিক?
মন্ত্রী মহোদয় ‘রিবা’ কে ‘অমানবিক’ এবং ‘সুদ’কে মানবিক বলে যে মন্তব্য করেছেন। কারো কারো মতে, কুরআনে নিষিদ্ধ ‘রিবা’র মধ্যে মানবিক কোনো চিন্তা ছিল না। তার মানে তারা মনে করেন, কুরআনে নিষিদ্ধ ‘রিবা’ চক্রবৃদ্ধি সুদ অর্থাৎ উচ্চহারের সুদ, যা সময়ের সাথে সাথে দ্বিগুণ-তিনগুণ বা বহুগুণ বেড়ে যেত। তখনকার আরবে গরিব লোকেরা তাদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করার জন্য একান্ত বাধ্য হয়ে ঋণ গ্রহণ করত। তারা ঋণ নেয়ার পর ঋণের উপর বহুগুণ অতিরিক্ত অর্থ ধার্য করা হতো তা বহন করার মতো ক্ষমতা বা সামর্থ্য তাদের ছিল না। এই উচ্চসুদ ছিল নিতান্ত অন্যায় ও অমানবিক। আর এ জন্যই ‘রিবা’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে যারা ‘সুদ’-কে মানবিক বলেন, তাদের যুক্তি হলো, উৎপাদনশীল বাণিজ্যিক ঋণ সাধারণত ধনীরা নিয়ে থাকেন। এই ঋণ তারা ব্যবসার উন্নয়নে খাটিয়ে প্রচুর মুনাফা উপার্জন করেন। ফলে এ ক্ষেত্রে অমানবিকতার কোনো বিষয় ঘটে না। তাদের যুক্তিতে প্রচলিত ব্যাংকিং-এ বাণিজ্যিক সুদ অমানবিক না হওয়ায় তা হারাম নয়। আর ‘রিবা’ অমানবিক বিধায় তা হারাম। এই ধারণাভ্রান্ত ও অমূলক। কেননা, কুরআনে ‘রিবা’ দ্বারা কেবল উচ্চহারের সুদ বুঝানো হয়নি। আবার ঋণগ্রহীতার সামর্থ্য কিংবা ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ভিত্তিতে সুদের কোনো শ্রেণিবিভাগ করা হয়নি। তা ছাড়া ব্যাংকিং সুদ ও মহাজনি সুদ, ভোগের জন্য নেয়া সুদ ও ব্যবসার সুদ, গরিবের সুদ ও ধনীর সুদ-এর মধ্যেও কোনো পার্থক্য করা হয়নি। ইসলামে যা হারাম বা অবৈধ করা হয়েছে তা ধনী-গরিব সবার জন্যই হারাম ও অবৈধ। ইসলামে যা হালাল বা বৈধ বলে বিবেচনা করা হয়েছে তা সবার জন্যই হালাল ও বৈধ। হালাল-হারাম ও অধিকারের প্রশ্নে ইসলাম কখনও কোনো বিভাজন ও বৈষম্য করেনি। ফলে ‘সুদ’ যদি অবৈধ হয়, তাহলে ঋণগ্রহীতা ধনী বা গরিব যা-ই হোক না কেন সবার জন্য সুদ ধার্য করা অবৈধ। লেনদেনকারী ধনী হোক কিংবা গরিব হোক তাতে কিছু আসে যায় না। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন বাসাভাড়া একটি বৈধ লেনদেন। ভাড়াগ্রহীতা যদি গরিব হয় তবুও তার কাছ থেকে বাড়া নেয়া বৈধ। কেউ মনে করলে এটা বলতে পারেন যে, গরিব বলে তার কাছ থেকে ছাড়া কিছুটা কম নিলে তা লোকটির জন্য ভালো হয় এবং তার প্রতি ইহসান হয়। কিন্তু এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, গরিবের কাছ থেকে বাড়িভাড়া গ্রহণ করা হারাম, অবৈধ অথবা অমানবিক। প্রকৃতপক্ষে, কুরআন ও হাদিসে ‘রিবা’ বা ‘সুদ’ হারাম গোষণা করা হয়েছে সকল ক্ষেত্রে-ভোগব্যবহারের উদ্দেশ্যে নেয়া ঋণের সুদ এবং বাণিজ্যিক বা ব্যাংকিং সুদ বিবেচনা করে নয়। অন্যদিকে যারা ভোগব্যবহারের উদ্দেশ্যে নেয়া উণের সুদ ‘অমানবিক’ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উদ্দেশ্যে নেয়া ঋণের সুদ বা বর্তমান ব্যাংকিং সুদ ‘মানবিক’ হওয়ার দাবি করেন, তারা সঠিক ধারণা করেন না। কেননা, ব্যাংক উভয় ধরণের ঋণের বেলায় সুদ আরোপ করে। একজন গরিব লোক যেমন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন, একজন ধনী গ্রাহকও তার বিলাসিতার জন্য ভোগ্যঋণ গ্রহণ করতে পারেন। তাই কোনো সুদই মানবিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সুদ মাত্রই অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য।
এ ব্যাপারে আল-কুরআনে সূরা আর রুমের ৩৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘তোমরা সুদের ভিত্তিতে যা কিছু দিয়ে থাক, তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না।’ আল্লাহ পাক সূরা আল-বাকারার ২৭৮ নাম্বার আয়াতে আরো বলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদ থেকে যা বাকি রয়েছে তা ছেড়ে দাও-যদি তোমরা মু’মিন হও।’ বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ এবং অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক ‘সুদ’ খারাপ বা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছে। বরং ‘সুদ’ মানবতাবিরোধী ও নিন্দনীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তুমি যা খরচ করো বা মাফ করে দাও, তার ওপর সুদ গ্রহণ করা বৈধ নয়।’ খ্রিষ্ট ধর্মে বলা হয়েছে, ‘ধার দাও, তার বিনিময়ে কিছু আশা না করে।’ হিন্দু ধর্মে ‘মনু’ এর বিধিমালায় ‘সুদ’ লেনদেন অবৈধ করা হয়েছে। বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, ‘সুদ মানবতাবিরোধী, অন্যায় ও জুলুম।’ অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘সবচেয়ে ঘৃণিত হচ্ছে সুদ যার দ্বারা অর্থ নিজ থেকে অর্থ উপার্জন করে।’ কার্ল মার্কস সুদের ব্যবসায়ীকে ‘বিকট শয়তান’ বলে মন্তব্য করেছেন। থমাস একুইনাস বলেন, ‘ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রহীতার কাছে সময়ের মূল্য (সুদ) দাবি করা একটা ভ-ামি ও অসাধু ব্যবসা।’ ইতালীয় লেখক মিস্যাবু ‘সুদ’কে অযৌক্তিক বিষয় হিসাবে চিহ্নিত করে বলেছেন, ‘অর্থের ওপর সুদ ধার্য করার কোনো যুক্তি নেই।’ এভাবে সুদকে বিভিন্ন ধর্ম ও স্বনাম ধন্য অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকগণ অবৈধ ও অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছেন। ফলে ‘সুদ’কে (প্রচলিত সুদ) মানবিক বলার কোনো কারণ নেই।
ইসলামী ব্যাংকিং কি ‘ফ্রড’ (প্রতারণা)
‘ইসলামী ব্যাংকিং একটি ফ্রড’ বলে মন্ত্রী মহোদয় যে মন্তব্য করেছেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত শরীয়াহ আইন এবং জুরিসপ্রুডেন্সের ওর ভিত্তি করে সুপ্রতিষ্ঠিত। আর ইসলামী আইন ও জুরিসপ্রুডেন্সের মূল উৎস হলো কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস এবং ইজতিহাদ। ইসলামী আইনের ওপর ভিত্তি করেই ইসলামী ব্যাংকিং এখন দুনিয়ার প্রায় ৭৫টি দেশে চালু হয়েছে এবং ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকগুলোর সম্পদের পরিমাণ ১.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এর পরিমাণ ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকিং মুসলিম দেশেই শুধু নয় বরং এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অনেক অমুসলিম দেশেও সফলতার সাথে কাজ করছে। বর্তমান সভ্যতার শীর্ষ অর্থনীতির দেশ আমেরিকা ও আধুনিক ব্যাংকিংয়ের সূতিকাগার ব্রিটেনসহ বড় বড় দেশ জার্মানি, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, জাপান, চীন, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান শরীআহসম্মত পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
ইসলামী ব্যাংকিং এখন সারা বিশ্বে একটি আধুনিক ব্যাংকিংব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃত। প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং বা সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকিং এখন বাস্তবতা। দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বাস্তবতা নিয়ে উচ্চসিত প্রশংসা করা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত শক্তি নিয়ে। সুদের ভয়াল কুপ্রভাব ও অনৈতিক লেনদেন থেকে মুক্ত হয়ে মুনাফাভিত্তিক অথবা লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসায়িক লেনদেন পরিচালনার জন্য অর্থনীতিবিদ ও প-িতগণ ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ইসলামী ব্যংকিংকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালনার নির্দেশনা ও গাইড হিসাবে ‘ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক’ বা আইডিবি দায়িত্ব পালন করছে। ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠান আইডিবির অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে অন্তত ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থায়ন করেছে। ফলে ইসলামী ব্যাংকিং নতুন কোন ধারণা নয়, বরং দেশের সরকার ও রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বাংলাদেশ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশে এখন ২৩টি সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৮টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের ৮৪৩টি শাখা, ৭টি প্রচলিত ধারার বাণিজ্যিক ব্যাংকের (প্রাইম, ঢাকা, সাউথইস্ট, প্রিমিয়ার, যমুনা, দি সিটি ও এবি ব্যাংক) ১৮টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও ৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যাংকের (ট্রাস্ট, ব্যাংক এশিয়া, স্টান্ডার্ড, পূবালী, সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক) ২৭টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে। তা ছাড়া বিদেশী তিনটি ব্যাংকের (ব্যাংক আল-ফালাহ, এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক) রয়েছে ৪টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা। দেশের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোগুলোতে ২৬,১৩৫ জন কর্মী কাজ করছেন। এভাবে ইসলামী ব্যাংকিং বাংলাদেশে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
পৃথিবীজুড়ে ইসলামী ব্যাংকিং-এর ৩৮ মিলিয়ন গ্রাহকের মধ্যে ১৩ মিলিয়ন বা ৩৫ শতাংশ গ্রাহক এককভাবে বাংলাদেশে। উল্লেখ্য যে, বিগত পাঁচ বছরে (২০০৯-২০১৩) বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯.৬৮ ভাগ। তার বিপরীতে দেশের ব্যাংকিং খাতে গড় আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯.০৯ ভাগ। এ সময়ে বিনিয়োগে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭.৫৩ শতাংশ, যার বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৯.৬৫ শতাংশ। উক্ত সময়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদ যেখানে ১৯.৪৮ শতাংশ হারে বেড়েছে, সেখানে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সম্পদ বেড়েছে ২১.৩৪ শতাংশ হারে। আলোচ্য সময়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ইক্যুইটির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ২৩.৮৬ ভাগ, যার বিপরীতে দেশের ব্যাংকিং খাতে ইক্যুইটির প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬.৬২ ভাগ। ২০১৩ ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ছিল দেশের মোট আমানতের ১৮ শতাংশ। একই সময়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের হার ব্যাংকিং খাতের মোট বিনিয়োগের ২১ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ৩০.০৩ শতাংশ। শ্রেণীকৃত বিনিয়োগের দিক থেকেও ইসলামী ব্যাংকগুলো ভাল অবস্থায় রয়েছে। ২০১৩ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ যেখানে ছিল ৮.৯০ শতাংশ, আর ইসলামী ব্যাংকগুলোতে তা ছিল ৪.২ শতাংশ। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ রেমিট্যান্স। জুন ২০১৪ ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশের মোট রেমিট্যান্সের ২৮ শতাংশ আহরণ করেছে। আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকগুলোর শক্ত অবস্থান ছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমদানি ছিল ২১ শতাংশ এবং একই সময়ে রফতানির হার ছিল ২৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া আমানত-বিনিয়োগ অনুপাত হার ৯০ শতাংশের বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত-বিনিয়োগ হার ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিতে ছিল ৮৫.১০ শতাংশ। দেশের ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিকভাবে এই অনুপাত ছিল তারও নীচে ৭১.১৮ শতাংশ।
উপরোক্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম অত্যন্ত সফলতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে। এমনকি সম্প্রতি সমগ্র বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা গেল, তখনও ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত অবস্থানে ছিল। বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেখানে বন্ধ হয়ে গেল বা প্রণোদনা দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করল, তখন একটি ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো যে, ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশের প্রচলিত আইন-কানুন মেনে, ব্যাংকিং কোম্পানী আইনের আওতায় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধান ও নজরদারির মধ্যে থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম শরীআহ মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে রয়েছে আলাদা শরীআহ কাউন্সিল। তা ছাড়া ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের ব্যবস্থাপনা, গুণগত মান নিরূপণ, পরিচালন ও হিসাবের নীতিমালা ও নিয়মাচার তৈরি করতে বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গাইডলাইন অনুসরণ করে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, ‘ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’ (IFSB), ‘একাউন্টিং এন্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউট’ (AAOIFI) এবং ‘ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল রেটিং এজেন্সি’ (IIRA)। তাই ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালনাগতভাবে ইসলামী ব্যাংকিং নীতির বাইরে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। বরং অত্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে থেকেই ইসলামী বাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
উপরের আলোচনার আলোকে এ কথা দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়, ইসলামী ব্যাংক শুধু ধর্মীয় মতবাদের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং শক্তিশালী ও বাস্তবসম্মত অর্থনীতি ও ইসলামী জীবন দর্শনের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখন বিশ্বে একটি বিকল্প অর্থব্যবস্থার নিয়ামক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অনেকেই আশা করছেন, আগামী দিনের বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবে। অতএব, সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে ইসলামী ব্যাংকিং ‘ফ্রড’ বা ‘প্রতারণা’ বলা মোটেই সমীচিন নয়।
–লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সিনিয়র ব্যাংকার