আগে ডিপোর্ট পরে আপিল
অবৈধ ইমিগ্রেন্টদের ব্রিটেনে বসবাস অসনীয় করে তোলার পাশাপাশি সামগ্রিক অভিবাসন নীতিতে আমূল পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন সদ্য পুননির্বাচিত প্রাধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তাঁর প্রস্তাবিত নতুন আইনে অবৈধ ইমিগ্রেন্টদের জন্য ‘আগে ডিপোর্ট পরে আপিল’ এর বিধান আনা হচ্ছে। ২৭ মে বুধবার নতুন পার্লামেন্টের উদ্ভোধন উপলক্ষ্যে রানীর দেয়া ভাষণেই এ সংক্রান্ত নতুন বিল উত্থাপিত হচ্ছে। একইসাথে ইউরোপিয় ইউয়িনের (ইইউ) হিউম্যান রাইটস এক্ট থেকেও বের হয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ক্যামেরন সরকার। ওই আইনের পরিবর্তে ব্রিটেনে মানবাধিকার বিষয়ক নিজস্ব আইন চালু করবে। নতুন ইমিগ্রেশন আইনের পাশাপাশি মানবাধিকারবিষয়ক আইনটিও এক বছরের মধ্যে পাশ করবে রক্ষণশীল সরকার।
দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস (ওএনএস) জানায়, ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যে নেট মাইগ্রেশন ৫২ শতাংশ বেড়ে তিন লাখ ১৮ হাজার হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে দেয়া এক বক্তৃতায় ক্যামেরন অভিবাসন নিয়ে তাঁর কঠোর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। বছরে যে পরিমাণ লোক ব্রিটেনে আসে এবং যে পরিমাণ লোক ব্রিটেন ছেড়ে যায় তার পার্থক্যকে বলা হচ্ছে নেট মাইগ্রেশন।
কনজারভেটিভ দলের নেতা ক্যামেরন বলেন, তাঁর সরকার ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণে নতুন যেই বিল আনছে, তাতে অবৈধ অভিবাসীদের কাজ করাকে ফৌজদারি অপরাধ (ক্রিমিনাল অফেন্স) হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাদের অর্জিত অর্থ জব্দ করা হবে। এতদিন অবৈধ ইমিগ্রেন্টরা ধরা পড়ার পর আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পেতেন। নতুন বিলে সেই অধিকার রহিত করে ‘আগে ডিপোর্ট পরে আপিল’র বিধান আনা হচ্ছে। এরফলে এস্যাইলাম সিকার ছাড়া অন্যান্য অভিবাসী নিয়ম ভঙ্গের দায়ে ধরা পড়া মাত্রই তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো (ডিপোর্ট) হবে। তারপর তাদের ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে আপিল করতে হবে। এছাড়া অবৈধ ইমিগ্রেন্টরা যাতে বাসা ভাড়া না নিতে পারে ও ব্যাংকে লেনদেন করতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বিশেষ দায়িত্ব অর্পন করা হবে নতুন বিলে। ব্রিটেনের কোম্পানিগুলোকে ব্রিটিশ নাগরিকদের যাচাই করার আগে বিদেশ থেকে কর্মী নিয়ে আসতে না পারে সে বিষয়েও কঠিন শর্ত আরোপ করা হবে নতুন বিলে।
২৭ মে বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে নতুন পার্লামেন্টের অধিবেশন। রীতি অনুযায়ী এদিন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করবেন। রাণী তাঁর ভাষণে চলতি বছর সরকারের আইনী ও অথনৈতিক কর্মসূচিগুলো তুলে ধরবেন। ইমিগ্রেশন ও মানবাধিকার বিষয়ক আইনটি রাণীর ভাষণে যুক্ত হওয়ায় এগুলো সরকারের প্রথম বছরেই কার্যকর করা হবে- এমনটা নিশ্চিত। ইইউ হিউম্যান রাইটস এক্ট নিয়ে গত মেয়াদে তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসছিলো কনজারভেটিভ। হোম সেক্রেটারি থেরোসা মে বেশ কয়েকবার ওই আইন থেকে বের হয়ে আসার ঘোষণা দিলেও তখনকার জোট সরকারের অংশীদার লিবারেল ডেমোক্র্যাটস দলের আপত্তির কারনে তা করতে পারেননি। ব্রিটেন ওই আইনের অংশভূত দেশ হিসেবে সাক্ষর করার কারণে ব্রিটেনের আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট হতে না পারলে সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তিরা ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালতে বিচার চাইতে পারতেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে এমন যুক্তিতে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালত ব্রিটেন থেকে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী ও অবৈধ ইমিগ্রেন্টের বিতাড়ন আটকে দেয়। ওই আইন থেকে বের হয়ে এসে ব্রিটেনের নিজস্ব মানবাধিকার আইন চালু হলে ব্রিটেনের কোনো বাসিন্দা ইউরোপিয়ান আদালতে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। ফলে ব্রিটিশ আদালতের রায়ই হবে সর্বেসর্বা।
গত মেয়াদেই এসব নিয়ন চালু করতে চেয়েছিলেন জানিয়ে ক্যামেরন বলেন, তখন কোয়ালিশন সরকারের কণিষ্ঠ অংশীদার লিবারেল ডেমোক্র্যাটস দলের আপত্তির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, এবার নিরঙ্কশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা কনজারভেটিভ দলের মূল্য লক্ষ্যই হবে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করে ১৯৯০ দশকের পর্যায়ে নিয়ে আসা। ইতোমধ্যে ক্যামেরনের ষোষিত নতুন অভিবাসন নীতির নৈতিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন মহল। ‘কাউন্সিল ফর দি ওয়েলফেয়ার ইমিগ্রেন্টস’র পরিচালক আইনজীবী সায়রা গ্র্যান্ট বলেন, অবৈধরা নগদ অর্থের বিনিময়ে কাজ করে। নিজেদের ভরন পোষণর পর উদ্বৃত্ব অর্থ স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তাহলে আয় জব্দের বিষয়টি কীভাবে কার্যকর হবে? এছাড়া ‘আগে ডিপোর্ট পরে আপিল’ নীতি অভিবাসন কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দেয়ার পাশাপাশি অভিবাসীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করবে বলে সমালোচনা উঠেছে।
ধারণা করা হয় যে, যুক্তরাজ্যে ছয় লাখের বেশি অবৈধ অভিবাসী রয়েছে। গত মেয়াদে নেট মাইগ্রেশনের হার বছরে এক লাখের নিচে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হন ক্যামেরন। সেই ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নিয়ে ক্যামেরন গতকাল বলেন, তিনি এখনো ওই লক্ষ্যে স্থির রয়েছেন। সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে অভিবাসীদের কাছে যুক্তরাজ্যকে কম আকর্ষণীয় করে তোলার মাধ্যমে তিনি ওই লক্ষ্যে পৌছানোর নীতি গ্রহণ করেছেন।
ওএনএস এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে যারা যুক্তরাজ্যে বসতি গড়েছে তাদের বৃহৎ অংশ ইউরেপিয় ইইনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশের নাগরিক। গত মেয়াদে ক্যামেরন সরকার ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাইরের দেশগুলোর নাগরিদের জন্য নানা কড়াকড়ি আরোপ করে। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে বছরে দু শ পাউন্ড চিকিৎসা ফি চালু করে। কিন্তু ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারেনি। এবার ক্যামেরন ইইউতে যুক্তরাজ্যের থাকা না থাকা নিয়ে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তবে গণভোট আয়োজনের আগে ইইউ নাগরিকদের জন্য চার বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কল্যাণ সুবিধা স্থগিত করতে চায় যক্তরাজ্য। এটা করা হলে যুক্তরাজ্যে ইইউ নাগরিকদের জোয়ার বেশ কমে আসবে বলে মনে করছে সরকার।