রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক চাপ জরুরি
সহমানবের প্রতি মানুষের আচরণ যে প্রায়ই পশুর প্রতি আচরণের অমানবিকতাকেও ছাড়িয়ে যায়, ইতিহাসে বারাবারই তা দেখা গেছে। দাস-ব্যবসার যুগে আফ্রিকার কালো মানুষদের প্রতি দাস-পাচারকারী ও বাগিচা-মালিকদের আচরণকে বর্বরতা বলেই আধুনিক সভ্যতা গণ্য করে। অথচ এ সভ্যতার আনাচেকানাচে দাস-শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার্য দরিদ্র উদ্বাস্তুদের অবমানব গণ্য করার একই অভ্যাস দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে-দেশে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে শত শত উদ্বাস্তু মোটা অংকের বিনিময়ে পাচারকারীদের নৌকায় গাদাগাদি করে অকূল সমুদ্রে প্রতিদিন পাড়ি দিচ্ছে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় দাস-শ্রমিক হিসেবে কাজের সন্ধানে। তাদের অনেকেই সমুদ্রের পানিতে ডুবে মরছেন। যারা দেশান্তরের সৈকতে ভিড়ছেন, তাদের গোপন আস্তানায় লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। সেই সব আস্তানায় অনাহারে, অসুখে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের গণকবরে সমাধিস্থ করা হচ্ছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ড সীমান্তে এমনই এক গণকবরের সন্ধান বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের একাংশ ছাড়া মিয়ানমার হতে যে বিপন্ন রোহিঙ্গারা সাগরে ভাসছেন, তাদের কোনো ‘দেশ’ নেই। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই ১২ লাখ মানুষের ভোটাধিকার নেই, নাগরিক অধিকার নেই, পরিচয়পত্রও নেই।
রাষ্ট্র এই ‘না-মানুষ’র নিরাপত্তা দেয় না, উদ্বাস্তু ত্রাণ শিবিরেও তারা নিরাপদ নন। বঞ্চনা, অভাব-অনটন ও অনাহার হতে মুক্তির তাড়নায় মরিয়া এসব মানুষ ভিন দেশে কাজের আশায় পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে যান। হাজারে-হাজারে তাদের অভিবাসন শিরোধার্য করতে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার সরকার প্রস্তুত নয়। ফলে ওই সব দেশের জলসীমারক্ষক পুলিশ তাদের সৈকতে ভিড়তে দেয়নি, অনেক নৌকা মাঝসমুদ্রে ডুবেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় সমস্যাটির মানবিক সমাধানের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপে তিন দেশই আপাতত উদ্বাস্তুদের আশ্রয় ও ত্রাণ দিতে সম্মত হয়েছে। তবে তিন দেশেরই বক্তব্য সমস্যার মূলে রয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা। তাই ওই দেশকে সর্বাগ্রে তৎপর হতে হবে।
মিয়ানমারের সরকার তথাপি রোহিঙ্গাদের স্বদেশবাসী গণ্য করতে নারাজ। দেশের নানা কোণে ছড়িয়ে থাকা অগণিত জনজাতিকে স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে কি দেশের সামরিক শাসকরা, কি ‘গণতন্ত্রের প্রতিমা’ অং সান সুচি, উভয়েই মুখ ফিরিয়েছেন। ফলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নজরদারি বা কড়া ব্যবস্থাগ্রহণের তাগিদও তাদের নেই। বরং রোহিঙ্গারা দেশান্তরে পাচার হয়ে গেলেই যেন সরকারের মঙ্গল।
প্রতিবেশী যে সব রাষ্ট্র এই উদ্বাস্তুদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তারা মিয়ানমার সরকারের এই অমানবিক অবস্থানকেই গোটা সমস্যার জন্য দায়ী করেছে। মিয়ানমারে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের আবাহন হলেও রোহিঙ্গারা স্বীকৃতি পাবেন- এমন আশা কম। এমতাবস্থায় এক দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রজোট ‘আসিয়ান’, অন্যদিকে মিয়ানমারে লগ্নি করতে উদগ্রীব পশ্চিমী গণতন্ত্রগুলো, উভয়কেই ওই দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা আবশ্যক। -আনন্দবাজার পত্রিকা।