ম্যান বুকার ২০১৫ পেলেন হাঙ্গেরীর ঔপন্যাসিক ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই
এ কে আজাদ: ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই একজন কল্পনাপ্রবণ (ভিশনারী) লেখক। তার লেখায় অসাধারণ গভীরতা আছে, আছে বর্তমান সময়ের অদ্ভুদ রকমের কৌতুকময় বর্ণনা, আছে সৌন্দর্যের সম্মোহনী প্রকাশ। তার ‘সাতানতাঙ্গু, মেলাঙ্কলী অব রেসিস্টেন্স, আর সিওবো দেয়ার বিলো’ হলো বিশাল কর্মযজ্ঞ। এগুলোতে যেমন কল্পনা আছে, তেমনি আছে জটিল আবেগের সম্মিলন। মানবজীবনের যে হাস্যরস তা যেন ল্যাসলুর লেখায় পায় এক অসীম উৎকর্ষতা। এভাবেই ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ম্যান বুকার ইন্টারন্যাল প্রাইজ-২০১৫ এর বিচারক প্যানেলের চেয়ারম্যান বিজ্ঞ লেখিকা মেরিনা ওয়ার্নার।
আর ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই বলছেন, মহৎ সাহিত্যের নাকি অভাব। মানুষ মহৎ সাহিত্য চায়। তিনি মনে করেন, মানুষ ওষুধ চায় না, মানুষ চায় তার যেন ওষুধের প্রয়োজন আর না হয়। অর্থাৎ মহৎ সাহিত্যই যেন মানুষের মনে ওষুধের মতো কাজ করে।
হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই ল্যাসলুর সাহিত্য যেন মানুষের মনে ওষুধের মতো কাজ করে। ভিশনারী এই ঔপন্যাসিকের ধারণা, তিনি কাউকে বলতে চান না যে কেউ তার বই পড়ুক। তিনি চান তার বই না পড়েই যেন মানুষ তাকে বুঝতে পারেন। তিনি মনে করেন, কেউ যদি তার বই বন্ধ করে বাইরে যায়, ছোট্ট একটা নদীর কিনারে সে যদি চুপিচুপি বসে পড়ে, সে যদি কোনো কিছু না করে, এমনকি সে যদি কোনো কিছু চিন্তাও না করে, সে যেন চুপ করে বসে থাকে নীরব পাথরের মতো। পরিশেষে সে এমন একজনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে, এমন একজনকে খুঁজে পাবে যে সেই ব্যক্তি ল্যাসলুর বই পড়ে ফেলেছে।
কোন লেখকের এত বড় সাহস আছে যিনি তার নিজের লেখা সম্বন্ধে এমন আস্থা প্রকাশ করতে পারেন? কোন্ লেখকের এত বড় বুকের পাটা যে তিনি এমন সাহসী উচ্চারণ করতে পারেন? তিনিই হাঙ্গেরীর সেই ভিশনারী ঔপন্যাসিক ও স্ক্রিন রাইটার ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই। গত ১৯ মে-২০১৫ ম্যান বুকার প্রাইজ কমিটি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এন্ড এলবার্ট মিউজিয়ামে একটি অনুষ্ঠানের ম্যাধ্যমে ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাইয়ের নাম ঘোষণা করেছে বিজয়ী হিসেবে। সারা বিশ্বের দশটি দেশের মনোনীত প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে হাঙ্গেরীর এই ঔপন্যাসিকের নাম বেছে নেন ৫ (পাঁচ) সদস্যের বিচারক প্যানেল।
ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজের ইতিহাসে ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই হলেন ৬ষ্ঠ ব্যক্তি। প্রতি ২ বছর পরপর ৬০,০০০/- (ষাট হাজার) পাউন্ড অর্থমূল্যের এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। তবে ল্যাসলু তার পুরস্কারের ১৫০০০/- (পনেরো হাজার) পাউন্ড তার উপন্যাসের ইংরেজী অনুবাদক কবি জর্জ সার্টেজ (যিনি ল্যাসলুর উপন্যাস ‘সাতানতাঙ্গু’ ও ‘দ্যা মেলাঙ্কলী অব রেসিস্ট্যান্স অনুবাদ করেছেন) এবং ওটিলি মুজলেট (যিনি ল্যাসলুর উপন্যাস ‘সিওবো দেয়ার বিলো’ অনুবাদ করেছেন) এর মধ্যে ভাগ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে ইসমাইল কাদারেকে পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০০৭ সালে চিনুয়া আচেবে, ২০০৯ সালে এলিস মনরো, ২০১১ সালে ফিলিপ রথ এবং ২০১৩ সালে এই পুরস্কার জিতেছিলেন আমেরিকার নারী গল্পকার লেডিয়া ডেভিস।
ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাইয়ের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি, হাঙ্গেরীর জিওলায়। পেশায় তিনি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। ফিল্মের স্ক্রিন রাইটারের কাজও করেন তিনি। বাবা জর্জি ক্রাসনাহোরকাই একজন আইনবিদ, আর মা জুলিয়া পুলিনকাস হাঙ্গেরীর একজন সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসক। পিতার মতো তিনিও পড়াশোনা করেছেন আইন বিষয়ে, ডিগ্রি নিয়েছেন হাঙ্গেরীর সিজেড বিশ্ববিদ্যালয় ও বুদাপেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশায় তিনি একজন ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। ফিল্মের স্ক্রিন রাইটিং এর কাজ করতেও দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি বিয়ে করেছেন বেশ বুড়ো(?) হয়ে, প্রায় ৩৭ বছর বয়সে ১৯৯০ সালে; মেয়ের নাম আনিকে পেলি। কিন্তু সে বিয়ে ভেঙ্গে যায় মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই। ১৯৯৭ সালে ফের বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই। এবার পাত্রীর নাম ডোরা কপসানী, তিনি সনোলজিস্ট ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই তিন সন্তানের জনক (কাতা, অ্যাগনেস ও এমা পনি)।
লেখালেখির জীবনে ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে হাঙ্গেরীর শীর্ষস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছেন ল্যাসলু। স্বদেশীয় হাঙ্গেরীয়ান ও জার্মান ভাষাতে সাহিত্য চর্চা তার। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি উপন্যাসসহ বেশকিছু গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত ল্যাসলুর গ্রন্থসমূহ হলো :
১। সাতানতাঙ্গু (উপন্যাস-১৯৮৫)
২। রিলেশন্স্ অব গ্রেস (ছোট গল্প-১৯৮৬)
৩। দ্য মেলাঙ্কলী অব রেসিস্ট্যান্স (উপন্যাস-১৯৮৯)
৪। দ্য প্রিজনার অব উরগা (উপন্যাস-১৯৯২)
৫। দ্য ইউনিভার্সাল থেসিউস (ফিকশনাল লেকচার-১৯৯৩)
৬। ইসাইয়াহ হ্যাস কাম (ছোটগল্প-১৯৯৮)
৭। ওয়ার এন্ড ওয়ার (উপন্যাস-১৯৯৯)
৮। ফ্রম দ্য নর্থ বাই হিল, ফ্রম দ্য সাউথ বাই লেক, ফ্রম দ্য ওয়েস্ট বাই রোডস্, ফ্রম দ্য ইস্ট বাই রিভার (উপন্যাস-২০০৩)
৯। ডেস্ট্রাকশন এন্ড সরো বিনিথ দ্য হেভেন্স (ছোটগল্প-২০০৪)
১০। দ্য ম্যান ফ্রম লন্ডন (চলচ্চিত্র-২০০৭)
১১। সিওবো দেয়ার বিলো (উপন্যাস-২০০৮, ২০১৩ সালে ইংরেজীতে অনূদিত)
১২। দ্য ট্যুরিন হর্স (চলচ্চিত্র-২০১৪)
এছাড়া তার ‘সাতানতাঙ্গু’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে বেশকিছু ছোটগল্প ও সাক্ষাৎকার। লেখালেখির সুবাদে পূর্ণ হয়েছে ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাইয়ের পুরস্কারের থলে। দেশী-বিদেশী বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তার প্রাপ্ত পুরস্কারগুলো হলো-
১। ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ-২০১৫
২। স্নোভেনিয়ার ভ্যালিনিকা প্রাইজ-২০১৪
৩। ওটিলি মুজলেট অনূদিত “সিওবো দেয়ার বিলো” উপন্যাসের জন্য আমেরিকার “বেস্ট ট্রান্সলেটেডেট বুক এওয়ার্ড”-২০১৪
৪। আমেরিকার “এওয়ার্ড ফর লাইফ টাইম কন্ট্রিবিউশন টু ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং-২০১৪”
৫। “টি এস এলিয়ট” পুরস্কার প্রাপ্ত কবি জর্জ জার্টেস অনূদিত উপন্যাস “সাতানতাঙ্গু”র জন্য ফের আমেরিকার “বেস্ট ট্রান্সলেটেড বুক এওয়ার্ড-২০১৩”
৬। প্রিমা প্রিমিসিমা প্রাইজ-২০১২ (বুদাপেষ্ট, হাঙ্গেরী)
৭। ব্রুক বারলিন প্রাইজ-২০১০ (জার্মানী)
৮। স্পাইছার প্রাইজ-২০১০ (লিউক, সুইজারল্যান্ড)
৯। প্রাইজ অব দ্য সোসাইটি অব রাইটারর্স-২০০৯ (বুদাপেষ্ট, হাঙ্গেরী)
১০। হাঙ্গেরীয়ান হেরিটেজ এওয়ার্ড-২০০৮ (বুদাপেষ্ট, হাঙ্গেরী)
১১। ২০০৭ সালে ফ্রান্সের জাঁ মনেট প্রাইজের জন্য মনোনীত।
১২। হাঙ্গেরীর রাষ্ট্রীয় পদক “কুসুথ প্রাইজ-২০০৪”
১৩। সরোস ফাউন্ডেশন প্রাইজ-২০০৩ (হাঙ্গেরী)
১৪। লরিয়েট অব দ্য হাঙ্গেরিয়ান রিপাবলিক-২০০২
১৫। হাঙ্গেরীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের “মারাই সান্দর প্রাইজ”-১৯৯৮
১৬। ক্রুদি জিওলা প্রাইজ-১৯৯৩ (হাঙ্গেরী)
১৭। জোসেফ অটিলা প্রাইজ-১৯৮৭ (হাঙ্গেরী)
১৮। মাইক কেলেমেন কোর প্রাইজ-১৯৮৭ (নেদারল্যান্ডস) প্রভৃতি
ম্যান বুকার প্রাইজ কমিটির বিচারকদের মতে, ল্যাসলু ক্রাসনাহোরকাই একজন পোস্ট মর্ডানিস্ট লেখক। আধুনিক ধারা থেকে তার লেখার ধরন খানিকটা ভিন্ন। তার লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- বড় বড় বাক্যবিন্যাস, অসম্ভব রকমের লম্বা। এগুলো ভাবগাম্ভীর্যতা থেকে চলে যায় হেয়ালীর দিকে; এগুলো যেন ধাঁধায়পূর্ণ। মাহাকাব্যিক এই বাক্যগুলো যেন অপ্রত্যাশিত ও অসম্ভবকে সম্ভব করতে জানে। আর পরিচ্ছেদগুলো যেন খানিকটা সঙ্গীতময়।