এরদোগান ও ইহজাগতিকতাবাদ

Erduganকিছুদিন আগেই তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়ব এরদোগান মিশর থেকে ঘুরে এলেন। এই সফরে গিয়ে তিনি সরাসরি বলেন, ‘কারোই ইহজাগতিকতাবাদকে (সেকুলারিজম) অস্বীকার করা উচিত নয়’। তার কথায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে অনেকেই বলে আসছিলেন এরদোগান ও তার ইসলামী গণতান্ত্রিক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (সংক্ষেপে একেপি) একটি গোপন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করছে। তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো উৎখাত করে সেখানে ইসলামী খিলাফত কায়েম করাই তাদের লক্ষ্য। যারা এমনটি মনে করতেন তারাই সব চাইতে বেশি অবাক হয়েছেন। এদের ভুল ব্যাখ্যা শুনে যেসব বিশ্লেষক এরদোগান সম্পর্কে ভুল ধারণা করে আসছিলেন এ বক্তব্য তাদের হৃদয়ে ভিন্ন ধারণার জন্ম দেয়।
বাস্তবতা হচ্ছে, গত এক দশক কাল ধরে এরদোগান ও তার অনুসারিরা বারবার এই কথাই বলে আসছিলেন। অল্প কিছু লোক বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের লোকজন ভান করতেন যেন তারা এমন কোনো কথাই শুনেন নাই। তারা এটাই বিশ্বাস করতে চান যে, একেপির সব তৎপরতার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে যে কোনো উপায়ে পুরনো ধাঁচের ইসলামী রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া।
কায়রো সফরে গিয়ে এরদোগান খুব ঠাণ্ডা ভাষায় গণতন্ত্র, বিশ্বাসের বহুত্ব ও ইসলাম বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এমন একজন মুসলিম যে নিজে ইহজাগতিক নই। কিন্তু আমি একটি ইহজাগতিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী এবং আমি আশা করব মিশরেও একটি ইহজাগতিক রাষ্ট্র গঠিত হবে। ইহজাগতিকতাবাদকে ভয় পাওয়া উচিত নয়। নতুন সংবিধান রচনার জন্য যাদের ডাকা হয়েছে তাদের অবশ্যই সব ধর্মকে শ্রদ্ধার সাথে দেখতে হবে। একই সাথে জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে সব ধর্মের অনুসারিদের থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তবেই মিশরে গণন্ত্রের বিকাশ ঘটবে।’
এরদোগানের এই বক্তব্য মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি অংশের কাছে হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। এরা ইসলামকে কঠোরভাবে মেনে চলার পক্ষে। তবে মধ্যমপন্থী হিসেবে পরিচিত দলের অপর অংশ এরদোগানের মতকে উদারতার সাথেই স্বাগত জানিয়েছে। এরদোগানের একে পার্টি জিনগতভাবেই এই ধরনের গণতান্ত্রিক ও ইহজাগতিক প্রতিষ্ঠানের ধারণা বহন করে আসছে এবং এই বিষয়টা অস্বীকার করারও কোনো সুযোগ নেই। তুরস্কের ইসলামপন্থী আন্দোলনের ঐতিহাসিক নেতা নাজিমউদ্দিন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন ভার্চু পার্টি ভেঙ্গেই জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির জন্ম। দলের ভিতরে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জের ধরেই ভাঙনের সূত্রপাত ঘটে। সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে দলের সংকীর্ণ মনোভাব বেশ কয়েকজন সদস্যকে ভাবিয়ে তোলে। তাদের মতে, রাজনৈতিক ইসলাম ও আধুনিকতা সম্পর্কিত পুরনো ধ্যান-ধারণা বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে একেবারেই সামর্থ্যহীন।
তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ্ গুল ও এরদোগান দুজনই এই মতের পক্ষে ছিলেন। তাদের এই পক্ষের সব চাইতে ক্যারিশমাটিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হত। তখন থেকেই তারা তাদের বক্তব্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে আনা শুরু করেন। বিশেষ করে হিজাবের উদাহরণ। আমেরিকার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেয়েদের হিজাব পরতে কোন বাধা নেই। কিন্তু তুরস্কে এটা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। আমেরিকার সমাজে ধর্মের প্রতি এই শ্রদ্ধাবোধ তাদের নজরে এসেছে। তবে শুধুমাত্র এই কারনেই তারা আমেরিকার বিষয় টেনে আনতেন না। বরং পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক হিসেবে বিবেচিত বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের সমর্থন জানাতেই তারা এই ধরনের বক্তব্য রাখতেন। আর সেই কারণেই তাদের বক্তব্যের মূল কথাই ছিলে এটা যে, তারাও আধুনিক হতে চান এবং তারা পশ্চিমের কিম্বা পুঁজিবাদের বিরোধী নন। তাদের মতে সব ইসলামী আন্দোলনই মূলত এই চরিত্র বহন করে।
এরদোগান ও তার দলের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তুরস্কের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উৎখাত করা কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে দেয়ার মত কোনো লক্ষ্য তাদের কখনোই ছিল না। তুরস্কের নিজস্ব মুসলিম চরিত্র ও প্রজাতন্ত্রের ইহজাগতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মের একটি অবস্থান তৈরি করাই ছিল তাদের প্রাথমিক অভিপ্রায়।
অবশ্য কামাল আতাতুর্কের হাতে গড়া সব প্রতিষ্ঠানই এর বিরুদ্ধে জোর প্রচেষ্টা চালায়। শুধুমাত্র ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা সেনাবাহিনীই নয়। বরং বিচার বিভাগের একটি অংশ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখাও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা অনুভব করে যে কোনো মূল্যে প্রজাতন্ত্রের জনক কামাল আতাতুর্কের ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। তাদের অনেকেই নাগরিক জীবনে ধর্মকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকে বিরাজমান ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে মনে করে থাকেন।
রজব তৈয়ব এরদোগান সর্বশেষ ২০১১ সালের জুন মাসে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছেন। এ নিয়ে পরপর তিনটি সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি এবং প্রতিবারই জেনারেলদের নিরংকুশ ক্ষমতা কমিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। এক্ষেত্রে তুরস্কের পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। আঞ্চলিক প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে তুরস্ককে প্রতিষ্ঠা করা একেপির অন্যতম রাজনৈতিক কৌশল। পণ্য এবং প্রভাব রপ্তানির মাধ্যমেই তারা এ পথে এগোতে চায়। পাশাপাশি নিজেদের ইসলামী মডেলের সাথে গণতন্ত্রকে যোগ করে নিয়েছে তারা। এটা কোনো সুফল বয়ে আনবে কিনা তা সময়ই বলে দিবে।
তবে সত্য কথা বলতে গেলে এরদোগান ও তার অনুসারিরা অন্তত এটা বুঝতে পেরেছেন যে, বর্তমান দুনিয়ায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে রাষ্ট্র ও ধর্মের সীমাবদ্ধতাগুলোর বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, বহুত্ববাদের স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা বিধান করার ব্যাপারেও অস্পষ্টতার কোনো সুযোগ নেই।
ইস্তাম্বুলের বিলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজি ওকতেম রিসেট-ডক পত্রিকায় কায়রোতে দেয়া এরদোগানের বক্তব্য ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘ইহজাগতিকতাবাদ সম্পর্কে কায়রোতে দেয়া এরদোগানের বক্তব্য খুবই সুস্পষ্ট। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের জন্যই নয় বরং ইসলামি বিশ্বে একেপি যে নতুন ধারার প্রবর্তন করতে চায় তার তাৎপর্য সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য এই বক্তব্য নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করবে।’
[ মূল লেখক নিকোলা মিরেনজি, মূল লেখা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ফ্রান্সিসকা সিমনস। আর ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন শাহ্ মোহাম্মদ ফাহিম ]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button