হাতকড়া পরিয়ে বিজিবি সদস্যের ছবি প্রকাশ করল মিয়ানমার
টেকনাফের নাফ নদী থেকে অপহরণের চার দিনেও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ফেরত দেয়নি মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি)। এ নিয়ে পতাকা বৈঠকের জন্য বিজিবির পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও বিজিপি কোনো সাড়া দেয়নি।
উল্টো হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় নায়েক আবদুর রাজ্জাকের ছবি প্রকাশ করেছে বিজিপির মুখপত্র ‘দ্যা গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার’। গত বৃহস্পতিবার ’বন্দুকযুদ্ধের পর সীমান্তরক্ষীদের হাতে বিদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আটক’ ইংরেজিতে করা এমন একটি শিরোনামের খবরে আবদুর রাজ্জাকের ছবি প্রকাশ করা হয়।
খবরে রাজ্জাককে গ্রেফতার দেখানো হয়। একই সঙ্গে তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা-বারুদ পাওয়ার কথাও বলা হয়।
শুক্রবার ই-মেইল ও ফ্যাক্সযোগে বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ পাঠানো হয় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে। এতে বলা হয়, বিজিবির একজন সদস্যকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন ও হাতকড়া পরিয়ে রাখা আন্তর্জাতিক কোনো আইনের মধ্যেই পড়ে না। বরং এগুলো মানবতাবিরোধী কাজ। এর মাধ্যমে শুধু বিজিবিকেই নয়, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে অপমান করা হয়েছে।
বিজিবির সূত্রে জানা গেছে, নায়েক রাজ্জাকের নেতৃত্বে বিজিবির ছয় সদস্যের একটি দল গত বুধবার সকালে নাফ নদীতে টহল দিচ্ছিল। দলটি বাংলাদেশের জলসীমায় মাদক চোরাচালানি সন্দেহে দুটি নৌকায় তল্লাশি করছিল। এ সময় মিয়ানমারের রইগ্যাদং ক্যাম্পের বিজিপির একটি দল ট্রলারে করে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। একপর্যায়ে টহল দলটি বিজিবির নৌযানের কাছে গিয়ে থামে। বিজিপির ট্রলারটিকে বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে যেতে বলা হলে তারা নায়েক রাজ্জাককে জোর করে ট্রলারে তুলে নেয়। এ সময় বিজিবির অন্য সদস্যরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এতে বিজিবির সিপাহি বিপ্লব কুমার গুলিবিদ্ধ হন। এরপর বিজিপির ট্রলারটি রাজ্জাককে নিয়ে মিয়ানমারের দিকে চলে যায়। বিপ্লবকে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিজিবি বলছে, আটক রাজ্জাককে ফেরত চেয়ে কয়েক দিন ধরেই যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে বিজিবি। এ বিষয়ে বিজিবি ও বিজিপির মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালে টেকনাফ স্থলবন্দরের ডাকবাংলোতে পতাকা বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমার বলছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় বৈঠক হয়নি। আজ আবার যোগাযোগ করা হলে বিজিপি জানিয়েছে, দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া রাজ্জাককে ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়।
বিজিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজ্জাককে ফেরত না দিয়ে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ৪০ মিনিটে বিজিপির ফেসবুকে তিনটি ছবি প্রকাশ করা হয়। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্জাকের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আর তাঁর পেছনে বিজিপির একজন সদস্য দাঁড়ানো। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্জাকের সামনে তাঁর অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী রেখে তাঁকে আসামির মতো করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আরেকটি ছবিতে তাঁকে হাতকড়া পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।
এই ছবির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিজিবির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, এসব ছবি বাংলাদেশের নজরে এসেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভের কথা তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজ্জাকের বাড়ি নাটোরে। বিজিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিজিবি ইতিমধ্যেই তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছে, রাজ্জাক নিরাপদ ও সুস্থ আছেন।
হঠাৎ করে কেন বিজিবির একজন সদস্যকে ধরে নিয়ে গেল-জানতে চাইলে বিজিবির একটি সূত্র জানায়, দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানো ছাড়াও ইয়াবা ও মানব পাচারে জড়িত। সম্প্রতি বাংলাদেশে ইয়াবাবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ার পর সাগরেই বারবার ইয়াবার চোরাচালান ধরা পড়ছে। নাফ নদীর জাদিমোড়া, যেখান থেকে রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখান থেকেই কয়েক বছরে ১২ লাখ ইয়াবা আটক করেছে বিজিবি।
রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং পতাকা বৈঠকে সাড়া না পেয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিজিবির সদস্য নায়েক রাজ্জাককে ফিরিয়ে দিতে ও পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে সীমান্ত পরিস্থিতি সমাধান করতে রাষ্ট্রদূতকে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এরপর ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো সাড়া দেয়নি বিজিপি।
এর আগে গত বছরের ২৮ মে বান্দরবানের পাইনছড়ি সীমান্ত এলাকায় বিজিপির সদস্যরা বিনা উসকানিতে বিজিবির সদস্যদের ওপর গুলি চালান। ওই সময় বিজিবির সদস্য নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। দুই দিন পর বিজিবির সদস্যরা মিজানুরের লাশ ফেরত নিতে গেলে উল্টো বিজিপি ওই প্রতিনিধিদলের ওপর আবারও গুলি চালায়। পরে ৩১ মে মিজানুরের লাশ ফেরত দিয়েছিল বিজিপি।