বাংলাদেশের মাহি : আমেরিকায় মুসলিম প্রতিচ্ছবি
আসিফ হাসান: প্রতিদিন ক্লাসমেটদের কাছে ইসলামের নিন্দা শুনতে হয়, ইসলাম নাকি তাদেরকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। ইসলাম সম্পর্কে নানা আজেবাজে মন্তব্য ছুটে আস। মাহি ছোট্ট একটা মেয়ে। বয়স মাত্র ১৩ বছর। আর কত ভালো লাগে। না, অন্যদের মতো সে না শোনার ভান করার অবস্থান থেকে সরে এলো। আমেরিকার সাধারণ মানুষ এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ইসলাম নিয়ে যে বিভ্রান্তি, ভুল বোঝাবুঝি চলছে, সেগুলো দূর করার সংকল্প নিল। স্কুলের কর্মকর্তাদের বোঝাল, এভাবে চলা যায় না। পারস্পরিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নতুন উদ্যোগ নেয়া হলো। এর সবই হয়েছে বাংলাদেশী মেয়ে সুমাইয়া মাহির কারণে।
গত ৯ জুন মেট্রো ডটকমে সে জানায়, ‘মুসলিম মেয়ে হওয়ায় আমাকে প্রতিটা দিন একই প্যাচাল শুনতে হতো। এমন পরিস্থিতিতেই ছিলাম আমি।’
‘তবে আমি এই অবস্থা দূর করতে চেয়েছিলাম। আমি যখন কাজটা শুরু করি, তখনই বুঝলাম, আমি একা নই। এ ধরনের পরিস্থিতি অনেকেই পড়েছে। তারাও কিছু করতে চায়।’
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যঅসাচুটসের ক্যামব্রিজের মতো আধুনিক আর অভিজাত নগরীতেও ইসলামবিদ্বেষ আর ভীতি ছিল প্রতিদিনকার বিষয়।
সে পড়ে কেনেডি লংফেলো স্কুলে। প্রতিদিন সে যেসব চ্যালেঞ্জে পড়ে সেগুলো থেকে উত্তরণ ঘটাতে ‘তুমি যা বলছ, তা তুমি নও, একটামাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া’ শীর্ষক একটা রচনার মাধ্যমে সব ছাত্রের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলো। গৎবাঁধা ধ্যান-ধারণা কিভাবে সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, বিভক্তির সৃষ্টি করছে, সেগুলো তুলে ধরার প্রয়াস ছিল এটা।
মাহির রচনাটি বিপুল সাড়া ফেলল। সামাজিক মাধ্যমগুলোকে তা ভাইরালে পরিণত হলো। পাবলিক রেডিও ইন্টারন্যাশনালের গ্লোবাল ন্যাশন এডুকেশন সেকশনে সেটা প্রকাশিতও হলো।
মাহি জানায়, ‘কাজটা ছিল খুবই কঠিন। কারণ লোকজন আমাকে সন্ত্রাসী মনে করত।’
সে লিখল, বাইরের ঘটনা কিভাবে তার ওপর চেপে বসেছে : ‘সমাজের দৃষ্টিতে এবং দুনিয়ায় যা কিছু ঘটছে, তার আলোকে আমাকে যে পরিচয়ে পরিচিত করা হচ্ছে, আমি সে নই। বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলা, বাংলাদেশের একটি ছেলের নিউ ইয়র্কে বোমা হামলার পরিকল্পনা করার মতো সহিংস ঘটনার কারণে আমি আর নির্দোষ মেয়ে বিবেচিত হচ্ছি না। মনে করা হচ্ছে, আমি একটা বাচ্চা সন্ত্রাসী।’
মাহি জানায়, আমার লক্ষ্য ছিল এই ভুল ধারণা ভেঙে দেয়া। আমি চাইনি, অন্য মুসলিম বাচ্চারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়–ক, উন্নতির দিকে যাওয়া থেকে বঞ্চিত হোক।’
মাহির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আগের একটি ঘটনা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তখনো তারা প্রতিদিন নানা পরিস্থিতিতে পড়ত। একদিন সে, তার বোন আর এক বন্ধু মসজিদ থেকে হেঁটে বাসায় ফিরছিল। তখন অনেক রাত। তারা সবাই হিজাব পরা। একটা পর্যায়ে দুই লোক তাদের দিকে হেসে বলল, ‘বিপদ! এরা মুসলমান!’
মাহি ফুসে ওঠল। চিৎকার করে বলল, ‘দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমাকে! তোমার আর বাঁচা হবে না বাছাধন!’
ওই দুই লোকের সাথে ঝগড়া তার মনে গভীর দাগ কাটল : ঘৃণা দিয়ে ঘৃণার মোকাবিলা করা যায় না।
ছোট্ট মাহির কাছে মনে হলো, মিডিয়াই মুসলমান সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী। তারাই মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারাই মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করছে।
মাহি এখন বলে, ওই দুই লোককে যেভাবে গালি দিয়েছিলাম, তেমনটা আর করি না। এখন বাচ্চাদের বলি, কেউ ইসলাম সম্পর্কে খারাপ কিছু বললে, তারা যেন সত্যিকারের ইসলাম কী, সেটা তাদের বুঝিয়ে বলে।
মাহির উদ্যোগ প্রথমে খুব সাড়া জাগায়নি। কিন্তু তার লেগে থাকার প্রয়াসে সুফল এনে দেয়। তার ইংরেজি শিক্ষক উডলি পিয়ের-লুই, যিনি প্রথমে তার বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি পর্যন্ত এখন তার চেষ্টার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
মাহি করে, ইসলাম সম্পর্কে ভীতি, ঘৃণা দূর করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলামের সত্যিকারের রূপটি তারাই তুলে ধরতে পারে।
মাহি বলে, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমান। আমার মধ্যে এই দুই বৈশিষ্ট্য আছ। তবে এর মানে এই নয়, আমি সমাজকে আঘাতকারী সন্ত্রাসী।’
যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ থেকে ৮০ লাখ মুসলমান বাস করে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ আমেরিকানই ইসলাম এবং মুসলমান সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না। তাদের এই অজ্ঞতা দূর করতে এগিয়ে এসেছে ছোট্ট মাহি।