মসজিদুল হারামে বিশ্বের বৃহত্তম ইফতার মাহফিল
নাছিম উল আলম: পবিত্র রমজানে মক্কা মোয়াজ্জেমায় মসজিদুল হারাম ও এর খোলা চত্বরে প্রতিদিন দশ লক্ষাধিক মুসল্লী ইফতার করছেন। পবিত্র জমজম কূপের পানির সাথে খেজুর-খোরমাসহ বিভিন্ন খাবার দিয়ে লাখ লাখ মুসল্লী ইফতারীতে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু এ অগণিত মানুষের ইফতার সামগ্রী নিয়ে নেই কোন কাড়াকাড়ি। নেই কোন বিশৃংলাও। বিশ্বের বৃহত্তম এ ইফতার মাহফিলের ইফতার সামগ্রী কোথা থেকে আসছে, তার সঠিক কোন হিসেব নেই কারো কাছে। এমনকি লাখ লাখ মুসল্লীর ইফতারী প্রস্তুত করতে কারো কাছে কেউ হাতও পাতেন না। তবে এত বিপুলসংখ্যক মুসল্লীর কেউই এখানে কোন কিছু কিনে ইফতারী করছেন না। কেউই শূন্য হাতেও ফেরেন না। এছাড়াও গোটা সউদী আরবের মত মক্কা নগরীর পথে প্রান্তরেও অজস্র মুসল্লী ইফতার করছেন। মক্কাবাসীরা নগরীর পথে পথে মুসল্লীদের মাঝে ইফতার বিতরণ করতে শুরু করেন আসরের নামাজের পর থেকেই। গোটা রমজান মাসই ইফতারীকে কেন্দ্রকরে গোটা মুসলিম বিশ্বের মত মক্কা নগরীজুড়েই যেন এক ধরনের উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। পবিত্র এ নগরীর রোজাদারগণ অপর রোজাদারের জন্য ইফতার পরিবেশন করেই যেন বড় তৃপ্তি লাভ করছেন। পুরো রমজান মাসজুড়েই সব ভেদাভেদ ভুলে মক্কার পথে প্রান্তরে এবং ইসলামের শীর্ষ ধর্মীয় পবিত্র স্থান মসজিদুল হারামে ইফতার সরবরাহ সকল মুসলমানের জন্যই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সওয়াবের কাজ। মসজিদুল হারামে ইফতার গ্রহণও অন্যতম পূণ্য ও সওয়াব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনকে রাজী ও খুশি করার বাসনাকে সামনে নিয়েই মক্কা নগরীর হাজার-হাজার মানুষ ছাড়াও পবিত্র ওমরাহ করতে আসা গোটা বিশ্বের অগণিত মুসলমানও যার যার সামর্থ অনুযায়ী ইফতার সামগ্রী নিয়ে ছোটেন মসজিদুল হারামে। তবে প্রায় সবার ইফতার সামগ্রীতেই নবীজী (সা:)-এর সুন্নাত আরব দেশের ঐতিহ্যবাহী খেজুর-খোরমার পাশাপাশি রুটিও থাকছে। এছাড়াও প্যাকেটজাত বিভিন্ন ফলের জুস, দুধ, মাঠা ও ঐতিহ্যবাহী দধি পর্যন্ত বিতরণ করা হচ্ছে ইফতার সামগ্রীতে। মুসাম্বী, মাল্টা, আপেল ও আঙ্গুরসহ নানা ধরনের পুষ্টিকর ফল নিয়েও আসছেন অনেকে ইফতারে বিতরণের জন্য। এমনকি অত্যন্ত ভালমানের আমের জুসও পাওয়া যায় এখানে ইফতারীতে। তবে সব কিছুর আগে অপরিহার্য পবিত্র জমজম কূপের পানি। আসর নামাজের পরেই মসজিদুল হারামের ভেতরে ও বাইরে ইফতার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। এসময় থেকেই জমজমের সুস্বাদু ঠান্ডা পানির কন্টেইনার ও গ্লাস মসজিদের বিভিন্ন অংশে স্থাপনসহ দস্তরখান বিছিয়ে একের পর এক লাইন করে ইফতারী সাজান শুরু হয়। ছোট-বড় আর ধনী-গরীবের ভেদাভেদ ভুলে সবাই একাকার হয়ে যাচ্ছেন পবিত্র কাবা ঘরের খোলা চত্বর ও মসজিদুল হারামে ভেতর-বাইরের ইফতার মজলিসে। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান মসজিদুল হারামের বিভিন্নস্থানে রোজাদারদের খোঁজে ছোটাছুটি করতে থাকেন ইফতারীর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। এরমধ্যে সউদী প্রবাসী অনেক বাংলাদেশী পর্যন্ত মসজিদুল হারামে রোজাদারদের ইফতার পরিবেশনে অংশ নিচ্ছেন। এদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশী দেখলে ছুটে আসছেন। ‘ভাই আসুন আমরা একসাথে একটু ইফতার করি’। এ ধরনের সম্বোধন করে যথেষ্ট তাজিমের সাথে নিজ দেশ ছাড়াও ভিন দেশী রোজাদারকেও নিয়ে যান ইফতারীর আয়োজনে। সকলেই ইসলামের অন্যতম মূলমন্ত্র সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শে মসজিদুল হারামের ভেতরে-বাইরে ও পবিত্র কাবার ঘরের খোলা চত্বরে ইফতার করছেন। একাধিক ইসলামী সেচ্ছাসেবী সংস্থাও এখানে ইফতার পরিবেশনে সংগঠিতভাবে কাজ করছে প্রতিনিয়ত। মসজিদুল হারামের প্রায় ৯০টি গেট দিয়ে রোজাদার মুসল্লীগণ কাবা ঘরসহ মসজিদে প্রবেশ করছেন। সব ভোদাভেদকে দূরে সরিয়ে একসাথে পাশাপাশি বসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে ইফতার গ্রহণের এ তৃপ্তি বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায় না বলে মনে করেন মসজিদুল হারামে ইফতার করতে আসা মুসল্লীগণ। মাগরিব আজানের সাথে সাথে সবাই একসাথে রোজা ভঙ্গ করে ইফতার গ্রহণ শেষে একই জামায়াতে নামাজ আদায়ের আনন্দও অন্য কিছুতেই পাওয়া যায় না বলে মনে করেন মুসল্লীগণ। নামাজের আগেই পুরো মসজিদের ভেতর-বাইরে ও পবিত্র কাবা ঘরের খোলা চত্বরই পরিষ্কার করে সকলে নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।এমনকি মসজিদুল হারামের বাইরে মক্কার রাস্তায় রাস্তায়ও পুরো রোজার মাসজুড়েই চলছে ইফতার সামগ্রী বিতরণ। মক্কা নগরীর যুবক ও কিশোররা মসজিদে ইফতারী ও মাগরিব নামাজ শেষ করে বাড়ী ফেরত মুসল্লীদের পথে পথে গরম চা ও কফি পরিবেশন করছে। বড় ফ্লাস্ক ও কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু-কিশোররা মসজিদুল হারাম ফেরত মুসল্লীদের হাতে গরম চা ও কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে এক ভিন্ন তৃপ্তি লাভ করছে। ইসলামের এ সৌভ্রাতৃত্ববোধ সকলকে অবাক করলেও যুগ যুগ ধরেই তাই বাস্তবতা পবিত্র মক্কা নগরীতে। পবিত্র কাবা ঘর চত্বর এবং মসজিদুল হারামের মত মক্কা নগরী ও এর সন্নিহিত এলাকার অন্য সব মসজিদেও প্রতিদিন চলছে ইফতার ব্যাপক আয়োজন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে রোজা রাখার মত তারই নির্দেশে ইফতারী মাধ্যমে তা ভঙ্গ করে এক কাতারে বসে খাবার গ্রহণ করার এ নিদর্শন বিশ্বের অন্য কোন ধর্মে বিরল হলেও ইসলাম এ ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দেরই শিক্ষা দিয়েছে। আর ইসলামের সর্ববৃহৎ পবিত্র স্থান মক্কা মোয়াজ্জেমার মসজিদুল হারাম এবং কাবা ঘর চত্বর এখন গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণের মানুষের অপূর্ব মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের মুসলমানদের কেবলা পবিত্র কাবা ঘর সত্যিই সবভেদাভেদ ভুলে সকলকে এক করে দিয়েছে।