মদ ও শিশার নেশায় নষ্ট হচ্ছে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানেরা
আবু সালেহ আকন: ছেলেমেয়ে সব একাকার। ছেলেদের মতোই স্কিন টাইট জিন্সের প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা মেয়েরাও। বেশির ভাগেরই চুল ছোট। আয়েশ করে বসে হুঁকা ফুঁকছে। দম নিচ্ছে, মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে আড্ডা দিচ্ছে অভিজাত হোটেলগুলোয়। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ওরা। ওই হোটেলে একবার ঢুকলে অন্তত ১০-২০ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে ঢুকতে হয়। আসক্তদের দিনে অন্তত দুইবার ঢুকতে হয় ওই হোটেলগুলোতে। স্বাভাবিক হোটেল মনে হলেও ওইগুলো হচ্ছে নেশার আস্তানা। ‘শিশাবার’ হিসেবে পরিচিত আসক্তদের কাছে। আগে ছিল গুটিকয়েক শিশাবার। এখন পুরো রাজধানীতেই ছড়িয়ে পড়েছে তা। রাজধানীজুড়ে কম হলেও ২০০ শিশাবার রয়েছে। এমনকি, খাবার হোটেলেরও এক কোনায় আলাদা কক্ষে ব্যবস্থা রয়েছে নেশার। যারা ওইগুলোতে অভ্যস্ত তারা সোজা গিয়ে ঢোকে ওই কোনার রুমে। থরে থরে সাজানো লম্বা পাইপওয়ালা হুঁকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের কাছে ইয়াবার পাশাপাশি এখন পছন্দের শীর্ষে ‘শিশা’ নামে নেশাটি। রাজধানীর বেশির ভাগ অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয়ই এখন এই নেশা বিক্রি হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে এই নেশার জন্য আলাদা রুম আছে। সেখানে থরে থরে সাজানো থাকে হুঁকার মতো নেশার পাত্র। হুঁকায় যেমন তামাক সাজানো থাকে, ওখানে হুঁকার কলকিতে থাকে শিশা নামে বস্তুটি। এর প্রধান উপকরণটি আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন ফল দিয়ে তৈরি হয় এই উপকরণ। তার সাথে মেশানো হয় গাঁজা এবং মরফিনের নির্জাস। হুঁকার মতোই টেনে টেনে সেবন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিশায় তীব্র নেশা হয়। গাঁজা ও মরফিনের নির্জাসে স্বাভাবিকের চেয়ে নেশার মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রায় এক মণ গাঁজা থেকে এক লিটারের মতো নির্জাস পাওয়া যায়। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছেও এমন তথ্য আছে। সূত্র জানায়, প্রকাশ্যেই কিছু কিছু হোটেল রেস্তোরাঁয় শিশা বিক্রি হচ্ছে। পুরান ঢাকার এক যুবক মামুন জানান, নামীদামি রেস্তোরাঁগুলোর এখন মূল ব্যবসা হচ্ছে এই শিশা বিক্রি। মামুন জানান, তার বান্ধবী এই নেশায় আসক্ত ছিল। এক সময় মামুনের মোটরসাইকেল বিক্রি করে দেয় ওই বান্ধবী। মামুন জানান, এক একবার শিশা সেবন করতে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দরকার হয়। ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের পাশে একটি হোটেল, আম্বালা-২, হোটেল-২৭সহ বেশ কিছু হোটেলে এই নেশার জন্য আলাদা বিশাল কক্ষই রয়েছে। রাজধানীর মগবাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তার দুই ছেলেমেয়েই এখন শিশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা দিতে হয় ছেলেমেয়েদের। ওই ব্যবসায়ী জানান, এখন তার পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ খুঁেজ পাচ্ছেন না তিনি। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের কাছে এই শিশাবার সংক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা এই নেশার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো তৎপরতা শুরু করেননি। ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা যে নেশা এবং মাদক সে বিষয়টি মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়নি। ফলে কোনো কর্মকর্তা চাইলেই এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালাতে পারেন না। ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা অবশ্যই মাদক। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে তা স্বীকৃত নয়। এ ব্যাপারে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। সংস্থাটির ডিজির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিশা যেহেতু স্বীকৃত মাদক নয়, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থা থেকেও এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গাফিলতির জন্য শিশা নামক মাদকের নেশা দ্রুতই বিস্তৃত হচ্ছে। এতে ধনাঢ্য পরিবারের অনেক সন্তান বিপথগামী হচ্ছে। এক কর্মকর্তা বলেছেন, শিশাবারে অভিযান চালানোর ব্যাপারে একটি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনেক মদের বারেও শিশাবারের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। সূত্র জানায়, ওইসব বারে গিয়ে অনেকে শিশার পাশাপাশি মদের প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ছে। ধনাঢ্য পরিবারের অনেক সন্তানই এভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেলের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেছেন, ইতঃপূর্বে শিশাবারগুলোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে।