ডেভিড ক্যামেরনের কথায় ব্রিটিশ মুসলমানদের মনে ক্ষোভ
১৬ বছরের কিশোরী আমিনা তার বন্ধুদের কাছে যখন গল্প করে যে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একবার তাদের বাড়ির অতিরিক্ত ঘরটিতে অতিথি হয়ে রাত কাটিয়েছিলেন, তারা কেউ বিশ্বাস করে না। খুব কম লোকই এ কথা স্মরণ করবে যে ক্যামেরন বার্মিংহামের স্বল্প আসবাবপত্র সজ্জিত সাদামাটা ঘরটিতে এক রাত অবস্থান করেছিলেন।
২০০৭ সাল। রক্ষণশীল দলের নেতার ভূমিকায় ক্যামেরন তখন ১৬ মাস পার করেছেন। দলের বদনাম ঘুচাতে তিনি ব্যস্ত। পার্শ্ববর্তী বালসাল হীথ এলাকার ওয়ার্ডেন ও ডিনার লেডি আবদুল্লাহ ও শাহিদার ঘরের অতিথি তাঁর হওয়ার কথা না হলেও হয়ে গেলেন। এ রাজনীতিবিদ দেখতে আগ্রহী হয়েছিলেন যে কম্যুনিটি পদক্ষেপ কীভাবে একটি সাবেক নিষিদ্ধ এলাকাকে বিকাশমান এলাকায় রূপান্তরিত করে। তিনি তা দেখে এতটাই অভিভূত হন যে বালসাল হীথকে বৃহত্তর সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা বলে আখ্যায়িত করেন। তার পরপরই গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত ক্যামেরনের ‘থ্যাংক ইউ নোট’ শীর্ষক নিবন্ধটি ছিল ব্রিটিশ এশিয়ান জীবন ধারা সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশক। তিনি লিখেছিলেন, আমি নিজেই এ কথা উপলব্ধি করি যে এটাই হচ্ছে মূলধারার ব্রিটেন যা অন্য কোনো দিকে না গিয়ে আরো একীভূত হওয়া দরকার।
এ সব দিনে আমাদের কীভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত সে ব্যাপারে ক্যামেরন কমই কথা বলেন। একগুচ্ছ সন্ত্রাস বিরোধী নীতি ও অহিংস উগ্রবাদ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে আইন প্রণয়নের পর গত মাসে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ বিশেষ ইসলামপন্থী উগ্রবাদী মতাদর্শ সমর্থন মূলক মত পোষণ করে। ডেইলি মেল নিন্মোক্ত শিরোনামে খবরটি পরিবেশন করে ’যুক্তরাজ্যের মুসলমানরা জিহাদিদের সাহায্য করছে, বলেন ক্যামেরন’।
ক্যামেরনের কথার এ পরিবর্তিত সুরকে তার সাবেক মেজবানরা কীভাবে দেখছেন? বালসাল হীথ ফোরামের পক্ষে এখনো কর্মরত ৪৫ বছর বয়স্ক রহমান বর্তমানে প্রধান নির্বাহী। বছরের উষ্ণতম একটি দিনে রোযা রেখেও বন্ধুভাবাপন্ন ও ক্লান্তিহীন রহমান বলেন যে তার সাবেক অতিথির ব্যাপারে তিনি হতাশ। তিনি বলেন, আমি ক্যামেরনকে আমার বাড়িতে স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্ত ব্রিটিশ মুসলমানদের ব্যাপারে তার কথা আমাকে ব্যথিত করেছে। এখন তারা মনে করে যে তাদের উপর অন্যায়ভাবে কলঙ্ক আরোপ করা হচ্ছে।
মাঝের বছরগুলোতে ক্যামেরন তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বজায় রাখেন, এ শহরে সফরে এলে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ডাউনিং স্ট্রিটে আয়োজিত ঈদ পার্টিগুলোতে তাদের দাওয়াত দিয়েছেন, বড়দিন উপলক্ষে কার্ড পাঠিয়েছেন, এমনকি তাদের দু’ মেয়ে আমিনা ও জয়নাবকে হাতে লেখা চিঠিও দিয়েছেন। রহমানের পরিবার তাদের বাড়িতে ক্যামেরনের আগমনের স্মৃতিবাহী ফটো অ্যালবাম দেখান। আরো দেখান একটি শোক প্রকাশক চিঠি যা ক্যামেরন লিখেছিলেন রহমানের মায়ের মৃত্যুতে। যিনি এ ধরনের ব্যক্তিগত সহৃদয়তা প্রদর্শন করেছেন, যাকে তিনি আন্তরিক ও একজন ভালো শ্রোতা মনে করেন, সেই প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। তা সত্ত্বেও তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কথার সুরে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং যার সমালোচনা করেছেন ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ারসি, তার সাথে তিনি জোরালোভাবে একমত।
ব্যারোনেস ওয়ারসি বলেছিলেন, ক্যামেরন মুসলিম সম্প্রদায়কে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। রহমান এ এলাকায় একজন সুপরিচিত ব্যক্তি। তিনি অবশ্যই বালসাল হীথের জন্য গর্বিত। তিনি ঝুলন্ত বাস্কেট দেখান ও তরুণদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সরকারের কথাবার্তা ব্রিটিশ মুসলিমদের উপর কীভাবে চাপ সৃষ্টি করছে সে কথা বলতে গিয়ে তিনি গম্ভীর হয়ে ওঠেন।
রহমান বলেন, মুসলিম সম্প্রদায় অনুগত এবং তারা দেশরক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। রহমানের পিতামহ ৫০-এর দশকে যুক্তরাজ্যে আসেন। তার পিতা একটি দোকানের মালিক ছিলেন। তিনি বলেন,ইরাক ও সিরিায় যা ঘটছে সে সব যারা সমর্থন করে সেরকম কারো সাথে আমি কথা বলিনি। রহমান বলেন, তার (ক্যামেরন) বলা উচিত আমাদের অধিকাংশই ভালো কাজ করছে। আমরা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাধ্যমত লড়ছি। আমি আমার ব্রিটিশ প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরও সে অনুরোধ করতে পারি, কিন্তু তারা কি এখন আমার প্রতি সন্দেহপ্রবণ হবেন?
তিনি বলেন, মুসলিম সম্প্রদায় মনে করে তাদের টার্গেট করা হয়েছে। যখন কোনো মুসলমান সহিংসতা করে তখন সংবাদপত্রে আলাদা শিরোনাম হয়। জ্যাক ডেভিসের কাজ (জানুয়ারিতে এক শিখ দন্ত চিকিৎসককে হত্যার চেষ্টাকারী) কি সন্ত্রাসবাদ নয়? এটা আমাকে ভীত করে তুলেছে। আমার সন্তানরা কি প্রভুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের হামলার শিকার হবে?
রহমান বলেন, মুসলিম কম্যুনিটিগুলো সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কত দৃঢ়ভাবে কাজ করছে ও উগ্রবাদীদের কিছু মতের বিরোধিতা করছে তা দেখার জন্য তিনি পুনরায় তাকে এখানে আসার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ ফোরাম সে গ্রুপের সাথে সাথে কাজ করছে যারা সে সব তরুণদের নিয়ে কাজ করছে যাদের উগ্রপন্থার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া ফোরাম গত বছর ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হাতে নিহত ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যালান হেনিংয়ের নামে তাদের বার্ষিক পুরস্কারেরও নামকরণ করেছে। যে সব ব্যক্তি উগ্রপন্থীতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের ব্যাপারে সরকারী সংস্থাগুলোকে রিপোর্ট করার নতুন আইনে রহমান উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, এতে মানুষের কণ্ঠরোধের ঝুঁকি আছে। এটা লোকজনকে তাদের মত প্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, কারণ তাদের উগ্রবাদী হিসেবে দেখা হবে বলে আশংকা করছে।
তিনি বলেন, মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ বৃদ্ধি না করে বরং সরকারের উচিত সকল লোককে ঐক্যবদ্ধ করা। লোকজনকে সমাধানের অংশ করলে তারা দেশের আইন-কানুন মেনে চলবে। তিনি বলেন, যদি আপনার সন্তানরা বাড়ি আসে ও ভালবাসা পায় তখন বাড়ি ত্যাগ করার বিষয়টি তাদের মনের সর্বশেষ ইচ্ছা হবে। দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি সেখানেই বাস করবেন যেখানে ভালবাসা পাবেন।রহমান বলেন, ক্যামেরন তার সর্বশেষ আমন্ত্রণের জবাব দিয়েছেন। কিন্তু এবার তার ডায়রি একেবারে পূর্ণ এবং একটু ফাঁক পেলেই তিনি সফরের চেষ্টা করবেন বলে জানিেেছন। যাহোক, প্রধানমন্ত্রী যদি আবার তার অতিরিক্ত শোবার ঘরটিতে অতিথি হন তাহলে রহমানের পক্ষ থেকে তার প্রতি বার্তাটি পরিষ্কারঃ আমি এ দেশকে ভালবাসি, আমার পিতাও এ দেশকে ভালবেসেছেন, আমার সন্তানরাও এ দেশকে ভালবাসে। সুতরাং আমাদের অবদানকে খাটো করে দেখবেন না। -দি গার্ডিয়ান