বিমানে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি
প্রথমে খেতে দেয়া হলো জুস ও বাদাম। গ্রোগ্রাসে গিললেন হাড্ডিসার মানুষগুলো। এর আধা ঘণ্টা পর একটু ভারী টাইপের খাবারের সঙ্গে কোক ও পানি দিতেই হুড়োহুড়ি লেগে গেল। শীর্ণকায় মানুষগুলো মিনিট দুয়েকের মধ্যে তাদের বরাদ্দকৃত খাবার খেয়ে ফেললেন। অনেকে তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে কেবিন ক্রুকে কাকুতি মিনতি করে আরও খাবার চাইতে থাকেন। অনেক দিন খাই না। এ অনুরোধের পাশাপাশি এসব বাংলাদেশীরা দ্রুত খাবার শেষ করে কোমল পানীয় কোক ও পানি নেয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন। এটি কোন বাংলা সিনেমার দৃশ্য নয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকায় আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের ভেতরের চিত্র ছিল এমনই। ওই ফ্লাইটে সাগরযুদ্ধে জয়ীরা খাবার নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করেছেন। বিমানের ওই ফ্লাইটে প্রত্যক্ষদর্শী এক যাত্রী জানান, ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে সাগরপথে যেসব বাংলাদেশীরা মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন তাদেরই একটি অংশ ছিলেন ওই ফ্লাইটে। সবার পরনে ছিল এক রঙের টি-শার্ট। পা খালি। কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ওঠার পর পরই তাদের শিকল দিয়ে লাগানো হাতকড়া খুলে দেয়া হয়। মুক্ত জীবনে আসা এসব বাংলাদেশীকে বিমান উড্ডয়নের ১৫ মিনিট পর জুস ও বাদাম খেতে দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে ওই জুস বাদাম খাওয়া শেষ করে ফেলেন তারা। এরপর তাদেরকে বিমানের কেবিন ক্রু পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের কারও এক্সট্রা জুস লাগবে? একথা জিজ্ঞেস করা মাত্র ১০২ জনের সবাই হাত তুলে তাদের আরও জুস লাগবে বলে জানান। ফলে কেবিন ক্রুরা রীতিমতো বিপদে পড়ে যান। ফলে ২৮ লিটার জুস, ২৫ লিটার সফট ড্রিংক ও ৫০ লিটার পানি মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দেন ওই সব বাংলাদেশীরা। এক পাশের ওই সব কোমল পানীয় শেষ হলে অন্য পাশ থেকে ধার করে আনতে হয় কেবিন ক্রুদের। বিমানের অন্য পাশ থেকে খাবার এনেও তাদের চাহিদা মেটানো যায়নি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারী খাবারের পর বিমানের স্টুয়ার্ডরা শেষ মুহূর্তের কাজ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ২০ মিনিট পরই বিমান ল্যান্ডিং করবে বলে কেবিন ক্রুদের তাড়া দিতে থাকেন পাইলটরা। ওইভাবেই কাজ করছিলেন কেবিন ক্রুরা। এরপরও সাগর যুদ্ধে জয়ী কয়েক জন বাংলাদেশী কেবিন ক্রুদের কাছে এসে অনুনয় বিনয় করে বলতে থাকেন, স্যার আমাকে একটা খাবার দেয়া যায়, খুবই ক্ষুধা লাগছে। প্রতি উত্তরে স্টুয়ার্ডরা তাদের কাছে জানতে চান, আপনি না ১০ মিনিট আগে খাবার খেলেন। তখন অপলক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে বলছিল, ক্ষুধা ত আর মিটে নাই স্যার! বিমানে দায়িত্বপালন করা একজন কেবিন ক্রু জানান, অবশিষ্ট কোন প্যাকেট না থাকায় বাধ্য হয়ে ‘ক্রু ফুড’ অর্থাৎ নিজের খাবারটি শীর্ণকায় বাংলাদেশীদের হাতে তুলে দেন তারা। তখনই ঘটে বিপত্তি। ওই খাবার নিয়ে মেঝেতে বসে দুই তিন জন মিলে খাওয়া শুরু করে দেয়। তাদের দেখাদেখি আরও কয়েক জন এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে তারা বলেন, স্যার আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে দুইটা খাইতে দেন। এ সময় অন্য ক্রুদের খাবারও দিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তাদের কেবিন ক্রু বলেন, আপনাদের খেয়ে তাড়াতাড়ি সিটে যেতে হবে। এখনই বিমান ল্যান্ডিং করবে। তাদের মধ্যে কয়েক জন দাঁড়িয়ে হাত দিয়েই ৩-৪ মিনিটের মধ্যে খাবার শেষ করেন। খাবার শেষ করে যখন তারা সিটে বসছিল তখন কেবিন ক্রুদের উদ্দেশ্য করে ক্যাপ্টেন বলেন, দুই মিনিটের মধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান ল্যান্ডিং করবে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, ১০২ জন বাংলাদেশীর এমন অবস্থা দেখে পাইলট ও কেবিন ক্রুরা আবেগতাড়িত হয়ে যান। নিজেদের খাবার দিয়ে দেয়ার পাশাপাশি অনেকে বিমানবন্দরে নেমে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশীদের ফোন ও অর্থ সাহায্য দেন। বিমানের কেবিন ক্রুদের বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশীরা জানিয়েছেন, কয়েক মাস ট্রলারে করে মালয়েশিয়া যান তারা। এরপর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে চার মাস জেলে ছিলেন। জেলে থাকার সময় খাবার হিসেবে এক মুঠো ভাত ও অল্প শুঁটকি মাছ পানিতে সিদ্ধ করে দেয়া হতো। ময়লাযুক্ত খাবার পানি দেয়া হতো। থাকতে দেয়া হতো স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, মানব পাচারের শিকার ৪৪৫ জন বাংলাদেশী আকাশ পথে ঢাকায় ফিরেছেন। তাদের বাংলাদেশী হিসেবে দূতাবাস মারফত শনাক্ত করার পরই ফিরিয়ে এনেছে সরকার। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ফেরেন ১০২ জন। শুক্রবার ফেরেন আরও ৯৬ জন। এখনও মালয়েশিয়ার কারাগারে বন্দি বাংলাদেশীদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। -মানবজমিন